মায়ের সাথে স্বর্গীয় অনুভূতি ৭ম দিদার সাথে


আমি ফোনটা রেখে ঘড়িতে সময় দেখলাম। ভোর চারটে। এতো শীতে বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করছিলো না। কিন্তু কোন উপায় নেই। দাদাই কে শেষ দেখা দেখেই নিই।
বিছানা ছেড়ে হাতমুখ ধুয়ে বাগানে দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে মামাবাবু চাদর মুড়ি দিয়ে রাস্তার সামনে বাইক নিয়ে দাঁড়ালেন। কুয়াশাচ্ছন্ন অন্ধকারের মধ্যেই দিদার বাড়ি চলে এলাম। এতো শীতেও অনেক লোকজন দাদাইকে শেষ বিদায় জানাতে এসেছেন। আমি গাড়ি থেকে নেমে ভেতরে গিয়ে দেখলাম উঠনের মধ্যে বাবা দাঁড়িয়ে আছেন। তখনি মায়ের জন্য মন কেমন করে উঠল। আমি বাবাকে কিছু না বলেই ভেতরে ঢুকে গেলাম। দাদাইয়ের অন্তিম সাজসজ্জ্যা চলছে। আর মা সমানে কাঁদছে। পাশে দিদা এবং সরলা মাসি তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। সরলা মাসি মাকে পিঠ থেকে জড়িয়ে ধরে, “ও দিদি! তুমি এমন করে কেঁদো না গো! অসুখ করবে গো। তখন লোকের তোমাকে নিয়ে ছুটোছুটি পড়ে যাবে”।
দিদা চশমার কাঁচ মুছে মাকে বলল, “নিজেকে শক্ত কর মা।এমন করলে। তোর বাবার আত্মা কষ্ট পাবেন”। কিন্তু মা কোন কথায় শুনছিল না।
সরলা মাসি আমাকে দেখতে পেয়ে চোখ তুলল, “বাবু তোমার মাকে বোঝাও দেখিনি। ছোট ছেলের মত কাঁদছে শুধুই”।


আমি তাঁর কথা শুনে দরজা পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। সরলা মাসি উঠে দাঁড়ালেন। আমি তাঁর জায়গায় বসলাম। মা অচেতন। সে শুধু পাগলের মত কেঁদেই চলেছে। কারও কথা শুনছে না। আমি তাঁকে জড়িয়ে ধরে বললাম, “মা প্লিজ কেঁদো না। তোমাকে দেখে কষ্ট হচ্ছে আমার”।
ক্রন্দনরত অবস্থাতেই মা আমার গালে গাল ঠেকাল, “তুই তোর দাদাইকে খুঁজে এনে দে বাবু। আমি পিতাহারা হয়ে গেলাম…।ফিরিয়ে এনে দে আমার বাবাকে…।”
মায়ের কথার কোন উত্তর পেলাম না। চুপ করে বসেই রইলাম ।
সরলা মাসির গলার আওয়াজ পাচ্ছিলাম, “ ও শ্যামা কাকি। বলি ধূপ দানি থেকে ধূপ শেষ হয়ে গিয়েছে। ওটার একটু ব্যবস্থা কর। মেসো মশাইকে বের করার সময় এসে গেছে গো”।
মা আর দিদা মেঝে থেকে উঠে দাদাইয়ের মাথার দুপাশে তাঁরা বসল। মা দাদাইয়ের মাথায় হাত বোলাচ্ছিল, “বাবা! তুমি ফিরে এসো বাবা……..” ।
এমন মুহূর্তে শ্যামা দিদা হাতে করে ধূপ কাঠির গোছা এবং ঘষা চন্দন কাঠ নিয়ে এলেন। সেই সঙ্গে ছোট দাদু। তাঁর স্ত্রী। এবং পুরোহিত ভেতরে এলেন।
পুরোহিত সবাইকে শান্ত করে মন্ত্র উচ্চারণ করতে লাগলেন।


আমি দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিলাম। এই অভিজ্ঞতা আমার কাছে নতুন। মানুষের অন্তিম বিদায়েও তাঁকে পরিপাটি করে সাজানো হয়। কপালে কল্কা করা হয়। নতুন বস্ত্র পরানো হয়।
ঘরের বাইরে বাগানের একপাশে বাঁশের মাচা এনে রাখা হয়। তাঁর মধ্যেই নানা রকম সাজসজ্জা। বাইরে ভোরের অন্ধকার অনেকটায় কমে এসেছে। অবাক করার বিষয় হল এই শীতেও লোক জনের ভিড় কম নেই। বরং এক এক করে সব আসতে লাগলেন ৷
ভালো শিক্ষক হিসাবেই দাদাইয়ের খ্যাতনামা ছিল। সে কারণেও হয়তো এই জন সমারোহ। সবাই উঠোনে বাগানে রাস্তার পাশে এসে দাঁড়ালেন।


কীর্তনের দল খোল মাদল করতাল নিয়ে হাজির হল।
দাদাইকে এবার বের করা হবে। তাই বাবা, স্বরূপ মামারা ভেতরে গেলেন। আমি বাইরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। মা এবং দাদাইয়ের অন্তিম বিচ্ছেদ আমার পক্ষে দেখা সম্ভব ছিল না।
বাইরে থেকেই বুঝতে পারছিলাম ভেতরে একটা হট্টগোল হচ্ছে। সঙ্গে মায়ের এবং দিদার কান্না। প্রতিবেশী কিছু মানুষজনও ভেতরে ছিলেন। সরলা মাসির ব্যস্ততার শব্দ।
বাবা এবং মামার কথোপকথন ।
অবশেষে তাঁরা দাদাইকে বাইরে নিয়ে এলেন। ভোরের আলোয় দাদাইয়ের চির ঘুমন্ত মুখ দেখতে পেলাম। গায়ের তাঁর সাদা চাদর মোড়ানো।


মাথা বরাবর ছোট দাদু আর একজন বৃদ্ধ অথচ শক্ত পোক্ত লোক। আর দাদাইয়ের পায়ের দিকে বাবা এবং মামা বাবু। সবাই একটু তাড়া দিচ্ছিলেন। মরদেহ বারোঘণ্টার উপর হয়ে গিয়েছে। এতো ক্ষণ ঘরে রাখা অনুচিত ইত্যাদি।
দাদাইয়ের শরীর এখন বাঁশের মাচার উপর শায়িত। পুরোহিত মশাই সেখানে এসে পুনরায় মন্ত্র উচ্চারণ শুরু করলেন। এবং নানা রকম বিধি কার্যাদি সম্পন্ন করতে লাগলেন।
বাবা, মাকে সঙ্গে নিয়ে দাদাইয়ের মাথার দিকে বসলেন। সারা রাত কেঁদে মায়ের শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তাও সে কাঁদা থামায় নি। বাবা আমাকে হাতের ইশারায় ডাকলেন। আমি, মা আর বাবা, দাদাইয়ের মাথার পেছনে পরপর বসলাম। পুরোহিত বিড়বিড় করে মন্ত্র পাঠ করছিলেন। কিছু গাঁদা ফুল এবং গঙ্গা জল আমাদের হাতে দিয়ে দেওয়া হল। আমরাও পুরোহিতের বলা মন্ত্র উচ্চারণ করলাম। মা বসে থাকতে পারছিল না। বাবা তাঁর বাম
হাত দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছিলেন।

অবশেষে আমরা তিনজন মিলে দাদাইয়ের চরণে মস্তক ঠেকিয়ে স্বর্গগামী পথযাত্রীর আশীর্বাদ নিলাম। মুখাগ্নি নিয়ে প্রশ্ন উঠছিল। পুরোহিত বললেন নারী এই কাজে বর্জিত! সুতরাং মামাবাবু কেই এগিয়ে আসতে হল।
এবার দাদাইকে শ্মশানে নিয়ে যাবার পালা।বাবা,মামা, ছোট দাদু এবং ওপর এক ব্যক্তি তাঁকে কাঁধে নিলেন। আমারও শ্মশান যাবার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু তা বহুদূরে হওয়ায় বাবা আমাকে সেখানে নিয়ে যেতে মানা করে দিলেন। তিনি আমাকে মায়ের কাছে থাকার নির্দেশ দিলেন।
“বল হরি। হরি বোল”। ধ্বনি আরম্ভ হল ।
এদিকে মা’ তো পাগলের মত দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিলো। দাদাইকে যেন না নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু তাঁর করুণ আর্জি কেউ শুনল না। পাড়ার আরও মহিলা, সরলা মাসি, দিদা মাকে অনেক করে বোঝাতে লাগল। দিদার সিঁথিতে গাঢ় করে সিঁদুর লাগানো হয়েছে দেখলাম।
আমি হরি বোল” এবং খোল করতালের শব্দ অনুসরণ করে বাবাদের পেছন পেছন হাঁটতে লাগলাম। ছোট রাস্তা যেখানে শেষ হয়ে বড় রাস্তায় মিলিত হয়েছে সেখানে মৃত বহনকারী গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আমি সেই অবধি গিয়ে দাদাইকে অন্তিম বিদায় জানালাম। শ্মশান এখান থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে। কোপাই নদীর তীরে। কোপাই নদী যদিও দাদাইয়ের বাড়ি থেকে দেখা যায়।তবুও পায়ে হেঁটে যাওয়া যাবে না।


দাদাই কে গাড়িতে তুলে সবাই চলে গেলো। আর সেখানে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলাম। চোখ দিয়ে জল পড়ছিলো আমায়। প্রিয় জনের বিদায়ের বেদনা কি হয় আমি বুঝছি। মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বললাম, “দাদাই তুমি ভালো থেকো!!”।
সেখান থেকে আচমকা মায়ের কথা মনে পড়তেই ঘাড় ঘোরালাম। এই শীতের ঠান্ডায় একজন অজ্ঞাত পরিচয় বৃদ্ধ কাঁপতে কাঁপতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলো।
অবাক চাহনি তাঁর।
“বাবা! তুমিই কি দেবী মায়ের ছেলে?”
বুঝলাম মায়ের সম্বন্ধে বলছেন।
হেসে বললাম, “আজ্ঞে হ্যাঁ”।
“ওহ আচ্ছা বাবা। তোমার মাকে সেই কবে দেখেছিলাম। কলকাতায় বিয়ে হয়েছে। আজ তোমার দাদু মশাই কে নিয়ে গেলো। তিনিও ভালো মানুষ ছিলেন….। আমরা সবাই অতিথি। সবাই চলে যাবো….এক এক করে”। লোকটার আষাঢ়ে গল্প শুনে বুঝলাম। তিনি আমার সময় নষ্ট করছেন। আমি তাকে হ্যাঁ হ্যাঁ বলে কোনো রকমে তাঁকে পাশ কাটিয়ে দিদার ঘরে ফিরলাম।
এখন সবকিছুই চুপ। নিস্তব্ধ একটা আবহাওয়া চলছে মনে হয়।
দিদার গলার আওয়াজ পেলাম। তিনি পাড়ার কয়েকজন মহিলার সঙ্গে বারান্দায় বসে দাদাইয়ের গল্প শোনাচ্ছেন। আমি ভেতরে আসাতে তিনি আমার দিকে চেয়ে দেখলেন, “এসো দাদু ভাই…..” ।
সরলা মাসিকে ডাকলেন, “এই সরলা। পূর্বের রুমটা পরিষ্কার আছে তো? দাদুভাই সারারাত জেগেছে। ওকে একটা শোবার ব্যবস্থা করে দে…”।
তিনি আবার আমার দিকে তাকালেন, “দাদুভাই এখানে ভীষণ ঠান্ডা। তুমি বাইরে ঘুরো না যেন। সরলা তোমার জন্য শোবার জায়গা করে দিচ্ছে তুমি সেখানে শুয়ে পড় হ্যাঁ…”।
দিদার কথায় আমি মাথা নাড়লাম।
সরলা মাসি তখনি আমাদের কাছে এলো। হাতের ব্যস্ততা শান্ত করে দিদার দিকে চেয়ে বলল, “হ্যাঁ দেবশ্রী দি’কে শাড়ি পাল্টে নাইটি পরিয়ে দিয়েছি। সে এখন নিজের রুমে ঘুমোচ্ছে। সারা রাত কি কাঁদলো বেচারী। তাঁকে দেখে আমার কি কষ্ট হচ্ছে গো….”।
আমি সরলা মাসির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “মা এখন ঠিক আছে তো? মা ঘুমাচ্ছে নাকি?”
“হ্যাঁ গো বাবু! তোমার মা এই ঘুমোলো। আমি তাকে শুইয়ে এই মাত্র বাইরে এলাম। আবার তাঁর কাছেই যাবো”।
মাকে দেখতে ইচ্ছা করছিলো। কিন্তু মা ঘুমাচ্ছে শুনে আর তাঁকে বিরক্ত করলাম না।
সরলা মাসি আমাকে পূর্বের একটা রুমে শুতে বললেন। এটা রুম নয় তবে বৈঠকখানা বলা যাবে। উত্তর দেওয়ালে একটা ছোট্ট খাট। পশ্চিম জানালা বন্ধ।পূর্বের জানালাও বন্ধ। অন্ধকারের মধ্যে যা দেখলাম তাতে বুঝলাম বিছানার পাশে একটা টেবিল এবং তার উপর কিছু বই রাখা আছে।
ঘুমের ঘোরে আমার মাথা যন্ত্রনা করছিলো। বিছানায় শুয়ে গরম কম্বল গায়ে দিতেই অঘোর ঘুমে চলে গেলাম।

2 thoughts on “মায়ের সাথে স্বর্গীয় অনুভূতি ৭ম দিদার সাথে”

Leave a Reply