আমি গাড়ির কাঁচ নামিয়ে জায়গাটার নাম দেখতে লাগলাম। ইলামবাজার। মোবাইল বের করে মায়ের বাড়ি আরও কতদূর দেখে নিলাম। বোলপুর ঢুকতে আরও সতেরো কিলোমিটার। তার মানে আর বেশি দেরি নেই। আর খুব বড় জোর আধ ঘণ্টা।
মাকে বললাম, “ আর বেশি দেরি নেই মামনি! বোলপুর চলে এসেছি প্রায়”।
মা আমার কথার কোন উত্তর দিলনা। চাদরটা ভালো করে গায়ে নিয়ে আমার কাঁধে মাথা রেখে পুনরায় চোখ বুজে দিলো।
পুরো জীবন বীরভূম জেলার বিভিন্ন স্কুলে শিক্ষকতা করে দাদাই নিজের পিতৃ ভুমিতেই বাড়ি বানিয়ে শেষ জীবন পার করলেন। দাদাই রা দুই ভাই। ছোট ভাইও বোলপুরেই থাকেন। তবে কিছুটা দূরে হয়তো। মুদির ব্যবসা আছে তাঁর। একমাত্র ছেলে মায়ের থেকে বয়সে ছোট।
দাদাই দের বাড়ি বোলপুর শহর ছাড়িয়ে আরও একটু ভেতরে যেতে হয়। উত্তর পূর্ব দিকে । শেষ বার যখন এসেছিলাম, মনে পড়ে বাড়িটা প্রায় গ্রাম লাগোয়া। যেখানে সবুজ গাছপালা এবং ধানক্ষেতও দেখতে পাওয়া যায়। লাল মোড়ামের কাঁচা রাস্তার দুই ধারে নানারকম গাছপালা । শাল,সোনাঝুরি,ইউক্যালিপটাস,বাবলা ইত্যাদি। প্রায় ছয় কাঠা জমি চারপাশে উঁচু প্রাচীর দিয়ে তার দক্ষিণ পশ্চিম প্রান্তে বাড়িটা বানিয়েছিলেন দাদামশাই।
উত্তর পূর্ব মুখী দোয়ার। কোন এক সন্ন্যাসীর নিষেধাজ্ঞায় দাদাই দুতলা বাড়ি বানাননি।
তাই লম্বা আয়তকার একতলা বাড়ির মধ্যেই চারটে রুম এবং পায়খান বাথরুম ও কুয়োর ব্যবস্থা আছে। বাড়ির সামনে বিরাট বাগান।
তার বাম পাশে কৃষ্ণ ঠাকুরের মন্দির এবং কীর্তন গান করার জন্য একটা উঁচু চাতাল উপরে টিনের গোল করে চার চালা বাঁধা।
কলকাতার বহু মানুষ এখানে জায়গা কিনে বাড়ি বানিয়ে থাকেন। সেহেতু অপরিচিত মনে হয়না জায়গাটা।
ইলামবাজার থেকে বোলপুর গামী রাস্তায় বাবা স্পীড কমিয়ে দিলেন। অন্ধকারের মধ্যেই জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগলাম। তারপর কখন জানি পৌঁছে গেলাম বুঝতেই পারলাম না।
ঘড়িতে সময় দেখলাম পৌনে দশটা।
পাঁচিলের ধারে গাড়ি দাঁড় করানো হল। মা বোধয় আগেই বুঝতে পেরে গাড়ি থেকে তড়িঘড়ি নেমে গেট খুলে ভেতরে চলে গেলো।
আমি আর বাবাও তাঁর পেছনে এগোতে লাগলাম। ঘরের দরজার সামনে প্রচুর লোকজন। আমাদের কে আসতে দেখে ঘুরে তাকালেন। কথা বলাবলি করতে লাগলেন। মা আমি আর বাবা ঘরের ভেতরে ঢুকেই দেখলাম লম্বা আয়তকার বারান্দার ডান দিকে কাঠের চেয়ারে দিদা বসে আছেন। তাঁর চুল খোলা। কিছু কম বয়সী মহিলা তাঁর পায়ের কাছে বসে আছে। এবং দুজন তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে তাঁকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন।
মাকে দেখেই দিদা কাঁদতে আরম্ভ করে দিলেন। মা ভয়ার্ত চোখ নিয়ে দিদার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “মা বাবা কোথায়?”
দিদা সশব্দে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করে দিলো। ঘরের মধ্যে উপস্থিত থাকা বাকী সদস্য রা মাকে হাত দেখিয়ে দাদুর ঘরে নিয়ে গেলো।
মা হতভম্বের মতো সেদিকে সজোরে হাঁটা দিলো। চোখে মুখে আশ্চর্যের ভাব। দীর্ঘ নিঃশ্বাসে বুক ফুলছে আবার নামছে।
মুখ্য দরজা দিয়ে বারান্দায় ঢুকে বাম দিকে অবস্থিত রুমের পর্দা সরিয়ে মা,আমি আর বাবা পরপর ঢুকে দেখলাম, পালঙ্কের উপর দাদাই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন। চিৎ হয়ে। বুক অবধি লেপে ঢাকা। নাসারন্ধ্রে তুলো গোঁজা। চোখ দুটো বন্ধ ।
মা’তো দাদাইকে দেখে খাটের ধারে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। ডান হাত বাড়িয়ে দাদাইয়ের বুকে উপর রেখে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল।
মায়ের মুখে আর্তনাদ, “বাবা! তুমি জেগে ওঠো বাবা! দ্যাখো তোমার মেয়ে তোমাকে দেখতে এসেছে। চোখ খোলো বাবা। চোখ খোলো!!!”
ক্রন্দনরত মায়ের হৃদয়ভগ্ন মুখশ্রীর দিকে চেয়ে থাকতে পারলাম না। দাদাইয়ের নির্জীব শরীরের দিকে তাকিয়ে তাঁর কাছে নিরর্থক প্রার্থনা করে বসলাম, “দাদাই তুমি পারলে উঠে দাঁড়াও! তোমার মেয়েকে জানিয়ে দাও এটা তোমার স্রেফ অভিমান মাত্র! মেয়ে বহুদিন ধরে আসছেনা দেখে এই অভিনয় করছ!”
কিন্তু নাহ! কঠোর সত্য হল এই যে দাদাই আর বেঁচে নেই।
বাবাও মায়ের পেছনে হাঁটু মুড়ে বসে মায়ের দুকাঁধে হাত রেখে তাঁকে সান্ত্বনা দিতে লাগলেন, “এমন করে কেঁদোনা দেবো। নিজেকে শক্ত কর। যা হবার তা হয়ে গিয়েছে…”।
আমিও মায়ের পাশে বসে পড়লাম। বাম হাত দিয়ে তাঁর ডান কাঁধ চেপে ধরলাম, “মা প্লিজ তুমি এভাবে কেঁদো না। আমার কষ্ট হচ্ছে তোমাকে দেখে”।
মায়ের চোখ দিয়ে অশ্রু বন্যা বয়ে চলেছে। ছোট্ট শিশুর মত কাঁদছে মা। যার পীড়া আমার কাছে অসহনীয়। তখনি সরলা মাসি, যিনি মায়েরই বয়সী। ছোট থেকে দাদাইয়ের বাড়িতে কাজ করে এসেছেন, মায়ের কাছে ছুটে এলেন, “ দেবী দি! এমন করে কেঁদো না গো! মেসো মশাইকে আমরা অনেক চেষ্টা করেছিলাম বাঁচানোর কিন্তু…”।
সরলা মাসি মায়ের পেছনে এসে বসতেই বাবা উঠে দাঁড়ালেন।মা সরলা মাসির কথা শুনে তাঁকে জড়িয়ে ধরে আরও জোরে কাঁদতে লাগলো।
আমি মায়ের ডান পাশে বসে মায়ের ডান হাত চেপে ধরলাম। মা কাঁদতে কাঁদতে উঠে দাঁড়ালো। তারপর দাদাইয়ের বুকের উপর মাথা রেখে চোখের জল ফেলতে লাগলো ।
সরলা মাসি মাকে জড়িয়ে ধরে তাঁকে বোঝাতে লাগলেন। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “বাবু তুমি বাইরে বস। মা’কে আমি দেখছি।অনেকক্ষণ বেরিয়েছ তো।তোমাদের জন্য চায়ের ব্যবস্থা করছি”।
তাঁর কথা মত আমি আর বাবা দাদাইয়ের কক্ষ থেকে বেরিয়ে বারান্দায় এলাম। দিদা কাঠের চেয়ারে হতাশ হয়ে বসে ছিলেন।
আমি দিদার কাছে এসে তাঁর কোলে মাথা রেখে বসে পড়লাম। তিনি আমার গালে নিজের বাম হাত রাখলেন। বাবার দিকে চোখ তুলে চাইলেন।
বাবা তাঁর সামনে এসে দাঁড়ালেন, “আপনি সেদিন পুরো ব্যাপারটা বলতে পারতেন মা” ।
শাড়ির আঁচল দিয়ে দিদা নাক মুছে আক্ষেপ করলেন, “হঠাৎ করেই তোমার বাবা অসুস্থ্য হয়ে পড়েছিলেন বাবা! তিনি তো চাপা মানুষ ছিলেন। আমাকে বলেছিলেন কিছু ভালো লাগছে না তাঁর। দিয়ে বিছানার মধ্যেই শুয়ে পড়েছিলেন। ডাক্তার ডেকে এনে দেখালাম। ডাক্তার বললেন ব্লাড প্রেসার নিতান্তই কম হয়ে পড়েছে। ঔসধ পত্ৰ দিয়ে যদি স্বাভাবিক না হয় তাহলে হসপিটালে ভর্তি করে দিতে…। ধীরে ধীরে সুস্থ্য হচ্ছিলেন তিনি…।। মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে মেয়ের কে দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। তোমরা বেড়াতে যাচ্ছ শুনে আর কিছু
বলিনি। এমনিতেই তোমরা আসবে বলেছিলে…. ।কিন্তু তিনি আজ দুপুরবেলা কাউকে না জানিয়েই বিদায় নিলেন”।
দিদার কথা শুনে বাবা হাঁফ ছাড়লেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘরের অপর একজন পরিচারিকা শ্যামা দি আমাদের চা দিয়ে গেলেন। বাবা চায়ের কাপ হাতে
নিয়ে চুমুক দিতেই মায়ের খুড়তুতো ভাই স্বরূপ মামা এসে হাজির হলেন। তিনি বাবাকে দেখে কথা বলতে লাগলেন। বাবা আর স্বরূপ মামা বাইরে বেরিয়ে গেলেন।
আমি দিদার কাছে থেকে উঠে এসে মায়ের কাছে গেলাম। দেখলাম মা দেওয়ালে পিঠ রেখে মেঝেতে বসে রয়েছে। তবে কান্নাকাটি বন্ধ করে দিয়েছে। হতাশার কালো মেঘ যেন ঘিরে রেখেছে তাঁর শরীরের চারপাশে। জলে ভেজা ক্লান্ত চোখ দুটো স্থির হয়ে দাদাইয়ের নিথর শরীরের দিকে চেয়ে আছে।
আমি মায়ের পাশে বসলাম। মায়ের কোন হুঁশ নেই। অপর পাশে সরলা মাসি মায়ের কাঁধে হাত রেখে জড়িয়ে ধরে আছে। তিনি মাকে বললেন, “দেবী দি! তোমার জন্য জল শরবত বানিয়ে দিই?”
মা তাঁর কথার কোন উত্তর দিলো না। ঠাই বসে একমনে সামনের দিকে চেয়ে ছিল।
এমন মুহূর্তে বাইরে লোকজনের কথাবার্তা শুনতে পেলাম।
সেখানকার অভিজ্ঞ মানুষেরা বাবাকে সঙ্গে নিয়ে দাদাইয়ের সৎকার সম্বন্ধে আলোচনা করছিলেন। রাতের বেলা মরদেহ বাড়ির বাইরে বের করা শাস্ত্র বর্জিত কাজ।আর দাদাইয়ের দেহ ত্যাগেরও বহু সময় ব্যায়িত হয়ে
গিয়েছে। তাই আগামীকাল খুব ভোরে দাদাইকে শ্মশান নিয়ে যাওয়া হবে।
সরলা মাসি মায়ের শীত করছে দেখে একটা চাদর এনে তাঁকে জড়িয়ে দিয়ে বাইরে চলে গেলেন। আমি মায়ের ডান দিকে বসে তাঁকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।
মা যেন এই জগতে নেই। মা কোন কথা বলছে না। কারও দিকে তাকাচ্ছেও না। শুধু একমনে বসে রয়েছে। দাদাইয়ের আকস্মিক পরায়ণে ভীষণ কষ্ট পেয়েছে বেচারি। আমি তাঁর দিকে চেয়ে তাঁর থুতনি হাত রেখে আদর সহকারে জিজ্ঞেস করলাম, “জল খাবে মামনি?”
মা মাথা নাড়ল।
আমি তাঁকে বিরক্ত করতে চাইছিলাম না। অনেক ধকল গেছে তাঁর উপর। সুদূর গোয়া থেকে কলকাতা। আবাক কলকাতা থেকে বোলপুর দৌড়ে আসতে হয়েছে।এক মুহূর্ত বিশ্রামের সময় পায়নি। পিতাহারা মেয়ের কষ্ট সহ্য হয়না।আমি মাকে একলা ছেড়ে দিদার কাছে চলে এলাম। দিদা ঘরের বাকী লোকজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন। আমি একটা চেয়ার টেনে তাঁর পাশে বসলাম। তিনি শাড়ির আঁচল দিয়ে চশমার কাঁচ পরিষ্কার করে পরে নিয়ে আমার দিকে তাকালেন। ঠোঁটে তাঁর অস্পষ্ট হাসি, “ দাদাই তো চলে গেলেন দাদুভাই!”
আমি তাঁর ম্লান হাসির মধ্যেও বেদনা লক্ষ্য করলাম। হাঁফ ছেড়ে বললাম, “হ্যাঁ দিদামণি! কখনও ভাবিনি এই
রকম হয়ে যাবে। দাদাই আমাদের না জানিয়েই বিদাই নিলেন….। ভেবেছিলাম এই বারের ছুটিতে বেড়াতে এসে দাদাইয়ের হাত ধরে শান্তিনিকেতন ঘুরতে যাবো। কিন্তু! তা আর হয়ে উঠল না”।
আমার কথা শুনে দিদা নিজের ডান হাত আমার থুতনিতে রাখলেন।
আমি তাঁর দিকে চাইলাম, “জানো দিদা! দাদাইয়ের এভাবে চলে যাবার কথা শোনার পর মনে হয়েছিলো যেন একটা যুগের অবসান হল। সেই কোন কালে ঠাকুর দা,ঠাকুমাকে হারাই। দাদাই সেই অভাব কোনোদিন বুঝতে দেননি। কিন্তু আজ মনে হচ্ছে অনেক বড় হয়ে গিয়েছি!”
দিদা এবার আমায় জড়িয়ে ধরলেন, “এমন বলতে নেই দাদু সোনা আমার! আমি আছি তো এখন। আমিই দাদাইয়ের অভাব পূরণ করে দেবো…”।
দিদার কথা গুলো আমার হৃদয় স্পর্শ করল। সদ্য তিনি স্বামী হারা হয়েছেন। তাসত্ত্বেও নিজ পৌত্র কে আশ্বাস দিচ্ছেন।
“কিন্তু দিদা! মা তো খুবই ভেঙ্গে পড়েছে। মাকে একটু বোঝাও নাগো। সেই তখন থেকে কেঁদেই চলেছে বেচারি…”।
আমার কথা শোনা মাত্রই দিদা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাদাইয়ের শোবার ঘরে এগিয়ে গেলেন। আমিও তাঁর পেছন নিলাম। মা মেঝেতে বসে ছিল। দিদাকে দেখা মাত্রই উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর বুক জড়িয়ে কাঁদতে শুরু করে দিলো। সঙ্গে দিদাও চোখের জল ফেলতে লাগলেন।
মা মেয়ে জড়াজড়ি করে ধরে কাঁদছিল। আমি তাঁদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলাম। দিদা মায়ের মাথায় হাত বোলাচ্ছিল, “কাঁদিস না মা। যা হবার তা তো হয়েই গেছে।কাঁদলে তো আর মানুষটা ফিরে যাবে না”।
মা মুখ তুলে দিদার দিকে চেয়ে কাঁদো গলায় বলল, “মা তুমি বড় অন্যায় করেছো। তুমি যদি একটি বার বলতে তাহলে আমরা সেই দিনই বেড়াতে যাওয়া কান্সেল করে বাবার চিকিৎসার ব্যবস্থা করতাম”।
দিদা, সব কিছুই কপাল রে মা। ভাগ্যে যদি এটা লেখা না থাকতো তাহলে এমন কিছুই হতো না”।
মা, “পরে তো আমায় জানাতে পারতে। তুমি তো বললে বাবা ভালোই আছেন…। তারপরেও?” দিদা মায়ের চোখের জল মুছিয়ে দিচ্ছিল, “পরে তিনি ঠিক হচ্ছিলেন মা। রক্তচাপ স্বাভাবিক হচ্ছিলো। ডাক্তার যেমন খাবার দাবার দিতে বলেছিলেন,সেই রকমই দিচ্ছিলাম মা। তা ছাড়া উনি হার্টের পেশেন্ট। বয়স হয়েছিলো তার”।
মা মেয়ের উত্তর প্রত্যুত্তরের মধ্যেই বাবা হাজির হলেন, “আর কান্নাকাটি করোনা দেবো। শরীর খারাপ করে যাবে তোমার”।
মা চোখের জল মুছে বাবার দিকে তাকাল, “বাবাকে কোলকাতায় নিয়ে গেলে বোধয় বেঁচে যেতেন”। বলে হাউমাউ করে আবার কাঁদতে শুরু করে দিলো, “এই আফসোস সারা জীবন আমার মধ্যে রয়ে যাবে”। মায়ের আর্তনাদ পেয়ে বাবা তাঁর কাছে আরও একটু এগিয়ে গেলেন। মাকে জড়িয়ে ধরার আগে আমার দিকে তাকালেন, “বাবু তুই বাইরে বস। দ্যাখ হয়তো তোর জন্য রাতের খাবারের ব্যবস্থা করে দিয়েছে”। সে মুহূর্তে আমার আর কিছু করার ছিল না।
দিদাও আমার সঙ্গে বেরিয়ে আসতে চাইছিলেন। মা তাঁকে বাধা দিলো, “মা! বাবার কাছে একটু বস না। বাইরে কেন যাও?”
দিদা চোখের জল মুছে মায়ের প্রশ্নের জবাব দিলেন, “তোর বাবাকে এভাবে দেখা যাচ্ছে না রে মা! আমি পারছিনা তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে”।
দিদার সেখানে থাকার দরুন বাবাও আর মাকে জড়িয়ে ধরতে পারল না। আমিও বেরিয়ে আসতে চাইছিলাম।
এমন মুহূর্তে দাদাইয়ের ছোট ভাই এসে উপস্থিত হলেন।
মা তাঁর দিকে তাকালেন, “এখন আসছ কাকাই?”
দাদাইয়ের ভাই মানে আমার ছোট দাদু মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “না রে মা। আমি আর তোর কাকিমনি সেই দুপুর থেকে ছিলাম রে মামনি! তোর কাকিমায়েরও তো শরীর ভালো নেই। হাঁটু কোমরের ব্যাথায় জর্জরিত। তার উপর এই বছর প্রচণ্ড শীত পড়েছে। তাঁকে রাখতে গিয়েই ফিরে এসে দেখলাম তোরা এসেছিস”।
এই মুহূর্তে পরিচয়, কুশল বিনিময়ের সময় নয়। সুতরাং আমিও আর এগিয়ে গিয়ে কথা বলতে পারলাম না। মা আর ছোট দাদুর মধ্যে একটা ক্ষুদ্র বাক লড়াই হয়ে গেলো। বাবা মাকে সামাল দিচ্ছিলেন। সে সময় স্বরূপ মামা তাঁদের মাঝখানে এসে দাঁড়ালেন।
তিনি ছোট দাদুকে একটু ধমক দিয়েই বললেন,
তোমরা এই রকম ঝামেলা শুরু করে দিও না তো! এগুলো
আগে ভাবলে যদিও কোন ফলাফল বেরত। এখানে দেবশ্রী দির কোন দোষ নেই। সে বেচারি বহু দূরে থাকে। এখানে কি হচ্ছে না হচ্ছে তাঁর না জানায় স্বাভাবিক…। তাছাড়া এখন প্রচুর কাজ পড়ে রয়েছে। ভোর হলেই আমরা শ্মশান বেরিয়ে পড়বো। পুরুত মশাই। কীর্তনিয়ারাও এসে পড়বেন”।
আমি ঘড়িতে সময় দেখলাম। রাত সাড়ে এগারোটা।
“এখন জ্যাঠা মশাইয়ের পাশে তোমরা বস।তাঁর অন্তিম বিদায়ে কোন ত্রুটি না হয় সে দিকে নজর দাও”। বলে স্বরূপ মামা আমার দিকে তাকালেন, “ চল মামু। তোমার জন্য আমাদের বাড়িতে খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে”। আমি তাঁর দিকে তাকালাম, “আপনাদের বাড়ি তো অনেক দূর মামাবাবু”।
“না না। মামু! মোটর সাইকেলে দশ মিনিট মাত্র”।
বাবাকে বললাম, “তোমরা খাবে না? বাবা?”
বাবা আমায় আশ্বাস দিয়ে বলল, “ তুই খেয়ে নে। আমি আর তোর মা দেখছি! কি হয়”।
আমিতো বুঝেই নিয়েছি। মা আর আজ রাতে খাবে না। বাবাও হয়তো কিছু একটা ব্যবস্থা করে নেবেন।
এমন মুহূর্তে মামা বাবু বাবাকে বললেন, “ আপনার জন্যও সেখানেই ব্যবস্থা করা হয়েছে দাদা। দেবশ্রী দি স্বাভাবিক হলে চলে আসবেন”।
বাবা তাঁর কথায় শুধু মাথা নাড়লেন।
পৌষ মাসের এই শীতে মামা বাবুর বাইকের পেছনে বসে তাঁদের বাড়ি চললাম।
“আচ্ছা মামা বাবু। দাদাইয়ের চিকিৎসার জন্য তোমরা কোন ব্যবস্থা নাওনি?”
মামা বাবু বাইক চালাতে চালাতে আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, “অনেক চেষ্টা করেছি মামু। তিনি তো ভীষণ জেদি মানুষ ছিলেন তাইনা। তার উপর ভয় পেতাম তাঁকে। দাপুটে মাস্টারমশাই নামে খ্যাতি ছিল তাঁর। তাই কথার উপর বিশেষ কিছু বলতে পারতুম না। মানে তাঁর উপর কেউ জোর খাটাতে পারতো না। সেবারে কলকাতাও খুব জোরাজুরি করে পাঠাতে হয়। এবারেও কোথাও যেতে চাইলেন না। তিনি হয়তো বুঝেই গিয়েছিলেন। তাঁর আর সময় বেশি নেই”।
আমি মুখ দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বললাম, “ওহ আচ্ছা!”
রাস্তায় যেতে যেতে তিনি আমার পড়াশোনা ইত্যাদি জিজ্ঞেস করছিলেন। মামা বাবুর বয়স প্রায় প্রয়ত্রিশ হলেও এখনও বিয়ে করেন নি।
যাইহোক রাতের খাবার এখানেই সম্পূর্ণ করে নিলাম। বাবা আমায় ফোন করে রাতে এখানেই শুয়ে পড়ার জন্য বলে দিলেন। তবে দাদাইয়ের মরদেহ নিয়ে যাওয়ার আগে যেন আমাকে ডেকে নেওয়া হয় সেটা জানিয়ে দিলাম তাঁকে। তিনি বললেন আমাকে যথা সময়ে ফোন করে নেবেন।
রাতে ঘুমের মধ্যেই আমার ফোনটা বেজে উঠল। বাবা ফোন করেছেন। বুঝলাম দাদাইয়ের শেষ বিদায়ের প্রস্তুতি নেওয়া আরম্ভ হবে। তিনি আমাকে তৈরি থাকতে বললেন। মামা বাবু আবার আমাকে নিতে আসবেন।
সব থেকে বেশি আবদেট এটা
Next pert তাড়াতাড়ি দাও