অনেকক্ষণ এসেছ নিশ্চয়ই…?” আস্তে আস্তে বলে উঠল বৌদি ।
“না…না, আমি এই একটু আগেই এসে…”
“থাক! আমার ভুল ঢাকতে তোমাকে আর মিথ্যে কথা বলতে হবে না । আমি জানি যে তুমি অনেকক্ষণ আগেই এসেছ । আসলে রাস্তাতে খুব জাম ছিল জানতো তাই কাজের জায়গা থেকে আগে বেরিয়েও দেড়ি করে পৌঁছলাম আমি…” মাথা নিচু করে বলে উঠল রেখা বৌদি ।
“আরে…সেসব বুঝতে পেড়েছি আমি, তবে তুমি কি সারাক্ষণ এইভাবেই নিজের মাথা নিচু করে থাকবে…?” আমি বলে উঠলাম ।
আমার কথা শুনে বৌদি নিজের মুখ তুলে আমার দিকে তাকাল । তবে তার মুখ দেখে বুঝলাম যে তার সেখানে দাঁড়াতে অস্বস্তি হচ্ছে । বুঝলাম যে আমার সাথে এই জনমানবের মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে সে ভয় পাচ্ছে । পাছে যদি কেউ তাকে চিনে ফেলে সেই কারণেই সে নিজের মাথা নিচু করে রয়েছে । বৌদির মনের ভাব বুঝতে পেরে আমি বলিঃ
“বৌদি তুমি এদিকে এসো আমার সাথে”
আমার কথা শুনে বৌদি আস্তে আস্তে আমার পেছন পেছন পারকিং অব্দি এলো । আমি আমার বাইকের সামনে গিয়ে বাইকে উঠে বললাম ঃ
“পেছনে বস আর এই হেলমেটটা পরে নাও”
“না না বাপু, আমার বাইকে চরার কোনও অভ্যাস নেই আমি পড়ে যাব…”
“কিচ্ছু হবে না…আমাকে একটু হলেও বিশ্বাস আছে তো নাকি তোমার…?”
“সে না হয় হল, কিন্তু যদি কেউ দেখে ফেলে…”
“আরে সেই জন্যই তো হেলমেটটা পড়তে বললাম তোমাকে, ওটা পড়লে তোমাকে আর কেউ বুঝতে পারবে না”
“কিন্তু কোথায় যাবে এখন…? “
“তুমি কোথায় যেতে চাও বলও, আমি নিয়ে যাব…” আমি বললাম ।
“এমন জায়গা যেখানে কথা বলা যাবে , গল্প করা যাবে…”
“আচ্ছা বুঝেছি তবে কতক্ষণ থাকবে…”
“ওই দশটার মধ্যে বাড়ি ফিরতে পারলেই হবে”
“ওহ!!! দশটা কি…তার আগেই তোমাকে পৌঁছে দেবো। চিড়ায়াখানার কাছে একটা ছোট ফ্যামিলি রেস্টুরেন্ট আছে, ওখানে যাবে ?”
“হ্যাঁ সে যাওয়াই যায় কিন্তু কোনও অসুবিধে হবে না তো…মানে”
“না, কোনও অসুবিধে হবে না…”
“কিন্তু তুমি কাওকে বলবে না তো আমি তোমার সাথে যাচ্ছি?” কিন্তু কিন্তু স্বরে বলে ওঠে বৌদি ।
“ন…না খেপেছ নাকি…তবে এবার বাইকে ওঠো তো তুমি…”
বৌদি আমার কথা শুনে কোন মত বাইকে উঠতেই, ওর হাতে হেলমেট ধড়িয়ে দিলাম আমি । হেলমেটটা মাথা দিয়ে গলাতেই আমি পেছনে ঘুরে স্ত্রয়াপটা লাগিয়ে দিলাম । আমি আগেই হেলমেট পড়ে নিয়ে ছিলাম তাই এবার বাইকে স্টার্ট দিলাম । বাইকের ইঙ্গিন গরজে উঠতেই আমি গিয়ার দিয়ে এক্সিলারেটরে জোর দিলাম আর সাথে সাথে বাইক এগোতে লাগল । পারকিং থেকে বেরিয়েই বাইকে স্পিড তুলতে আরম্ভ করলাম আর এতে বৌদি মনে হয় একটু ভয় পেয়ে গেল । সে আমার কমরটাকে নিজের হাতদিয়ে আঁকড়ে জড়িয়ে ধরল ।
“বাপু…আস্তে…আস্তে চালাও না, আমার ভয় লাগছে । পড়ে গেলে মড়ে যাব…যে…”
“না না কিচ্ছু হবেনা, তবে তুমি আমাকে আরও একটু জোরে চেপে ধর, তাহলে আর কোন ভয় থাকবে না “
আমার কথা সত্যি মনে করে বৌদি আমার কোমরটা আরও জোরে জড়িয়ে ধরল । কলকাতার সেই মকমলের মতন রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে প্রত্যেক ঝাকুনিতে নিজের পিঠের ওপর রেখা বৌদির নরম দুধগুলো অনুভব করছিলাম আমি । এরকম আধঘণ্টা যাওয়ার পর চিড়িয়াখানা ক্রস করলাম আমরা । তারপর সামনের একটা মোর ঘুরে বাঁদিকে সেই রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়ালাম আমি । গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে হেলমেট খুলতেই অনুভব করলাম যে বৌদি তখনও আমাকে সেই আগের মতই জড়িয়ে ধরে আছে । সেই দেখে আমি বল্লম ঃ
“বৌদি আমরা পৌঁছে গেছি, এবার আমাকে ছাড়তে পার তুমি…” আমার কথা কানে পৌঁছতেই বৌদি সম্বিত ফিরে পেল আর পেতেই আমার কোমর থেকে নিজের হাতের বাধন আলগা করে দিলো । তারপর বাইক থেকে আস্তে করে নেমে পাশে দাঁড়াল । আমিও বাইকটা পারকিঙ্গে লাগিয়ে বৌদিকে নিয়ে রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকলাম । রেস্টুরেন্টে ঢুকে ভেতরের অবস্থা দেখে যা বুঝলাম তাতে আমরা ছাড়া সেখানে আর কোন জনমানব ছিল না । হয়তো এই সময়ের কারণেই সেখানে কেউ নেই কারণ আগে এখানে যতবারই এসেছি প্রতেকবারি একগাদা ভির দেখতে পেয়েছি । বৌদিকে হেলমেট হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি বললাম ঃ
“কি গো বৌদি…কোথায় বসবে ?”
আমার কথা শুনে সে বলল,”তুমি যেখানে বলবে…”
“আচ্ছা তাহলে ওই কর্নার টেবিলটায় চলো” বলে বৌদিকে নিয়ে একপাশের কর্নার টেবিলে গিয়ে বসলাম আমি । বৌদির হাবভাব দেখে এটা পরিষ্কার বুঝতে পাড়ছিলাম যে সে এই রকম রেস্টুরেন্টের আগে কোনদিনও আসেনি । বাইরে গরম থেকে এসে এসির ঠাণ্ডা হাওয়া শরীরের লাগতেই কামন একটা তন্দ্রা ভাব আনুভব করলাম আমি । কিছুক্ষণের মধ্যেই ওয়েটার এসে আমাদের খাবারের অডারটা নিয়ে গেল ।
রেস্টুরেন্টের সেই আধো অন্ধকার আলর নিচে রেখা বৌদি আর আমি পরস্পরের মুখোমুখি বসে খাবারের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম, কিন্তু কি বলে নিজেরদের মধ্যে কথাবাত্রা শুরু করব সেটা হয়তো দুজনের মধ্যে কেউই বুঝতে পাড়ছিলাম না আমরা। তবে বলা বাহুল্য এরি ফাঁকে আমরা নজর বার বার বৌদির বুকের দিকে চলে যাচ্ছিল । বৌদি হয়তো সেটা বুঝতে পেরেছিল আর তাতে অস্বস্তি বোধ করে সে বলেই ফেলল ঃ
“কি দেখছ তুমি অমন করে বারবার?”
বৌদির কথা শুনেতেই আমি নিজের মাথা তুলে বৌদির চোখে চোখ রেখে বললাম, “তোমাকে, তোমাকে দেখছি গো…”
“ইসসস, কেন গো আগে দেখনি নাকি আমাকে বা অন্য কাউকে?”
“হ্যাঁ, সে দেখব না কেন…নিশ্চয়ই দেখেছি কিন্তু তোমার মতন সুন্দরী অনেককাল দেখিনি…”
“ধ্যাত, কি যে বল তুমি…এই তো রঙের ছিরি তার ওপর আবার কেউ সুন্দরী কি করে বলে আমাকে…”
“বৌদি, আমি মানুষের বর্ণ দিয়ে বিছার করার মতন ছেলে নই, জানি না অন্নরা কি করে তবে আমার বাপ মা সেই রকম শিক্ষা দেই নি আমাকে কোন দিন” আমি বলে উঠলাম আর লক্ষ্য করলাম যে আমার কথাটা শেষ হতেই বৌদির চোখ দুটো যেন একটু ঘোলাটে হয়ে গেল । ‘আমার কথা শুনে কি সে দুঃখ পেল নাকি…’
“কি হল ওইরকম চুপ করে গেলে কেন…?” আমি বলে উঠলাম ।
“না…না মানে অনেকদিন কারুর মুখে নিজের তারিফ শুনিনি তাই আজকে হঠাৎ…যাইহোক তুমি…তোমার…তোমার নামটা তো এখনও বললে না”
“ওহ হ্যাঁ, ঠিকি তো নামটা তো বলিনি তোমাকে, আমার নাম প্রীতম । বাড়ির লোকেরা আমায় প্রিয় বলে ডাকে আবার কেউকেউ দীপও বলে ডাকে…”
“বা সুন্দর নাম তো তোমার…বাড়ির সবাই নিশ্চয়ই তোমাকে খুব আদরে রাখে তাইনা…”
“জানি না, তবে বাড়ির মেজ ছেলে হওয়ার কারণে অ্যাই এম দ্যা আগ্লি ডাক…সবার থেকে আলাদা…”
“মানে…?” রেখা বৌদি প্রশ্ন করে উঠল।
“ওসব ছাড়ো না বৌদি, আমার কথা নাইবা শুনলে এখন, তবে তোমাকে বৌদি বৌদি বলে ডাকতে আমার একদমই ইচ্ছে করছে না আর…”
“আরে বাবা তোমাকে বললাম না তোমার যা ইচ্ছা তাই বলে ডেকো আমাকে, আমার কোন কিছুতেই আপত্তি নেই । তবে সবার সামনে আমাকে বৌদিই বলও নাহলে লোকেরা আবার সন্দেহ করবে…”
“আচ্ছা, তাই হবে সব, তবে থেকে ভালো তোমাকে দুটোরই মিশ্রণে ডাকি বরঞ্চ…”
“মানে…?”
“রেখা বৌদি” আমার মুখে সেই যুক্ত শব্দ শুনেতেই লক্ষ্য করলাম বৌদি নিজের নিচের ঠোঁটাটা হালকা করে কামড়ে ধরল । এরি মধ্যে ওয়েটার এসে আমাদের খাবার সার্ব করে দিয়ে গেল । আমরাও আর সময় নষ্ট না করে দুজনে খেতে খেতে গল্প করতে থাকলাম ।
” তোমার রোজের রুটিন খুব হেকটিক বলও…” বৌদি বলে উঠল ।
“হ্যাঁ… তবে তোমারও তো বেশ চাপ যা শুনে মনে হল…”
“হ্যাঁ চাপটা আরও বেশী মনে হয় যখন বাড়ির প্রত্যেকটা খরচা আমায় করতে হয়, আমার রোজগারে…”
“কিন্তু ভাই, মানে তোমার ছেলে তো কাজ করে…তাইনা ?”
“হ্যাঁ সে করে আর ছেলেটাও ভালো কিন্তু বাড়িতে রাখতে পারিনা জান তো, পাছে যদি আবার বাপের পাল্লায় পরে নেশারি হয়ে ওঠে সেই ভয়ে ” বৌদি বলল ।
“তাহলে ও বাড়িতে আসেই না একদম?”
“আসে, মাঝেমাঝে, নিজের বৌয়ের সাথে দেখা করতে। বুঝতেই পারছ নতুন বিয়ে হয়েছে ওদের, তাই নিজেরদের মধ্যে টানটাও এখনও বেশ শক্তপক্ত আছে ওদের”
“বুঝলাম, তাহলে সংসার চালানর পর তোমার হাতে কিছুই থাকে না ?”
“তুমি তো জানোই আমাদের বাড়ির অবস্থা, আর না আমি নিজের জন্য কিছুই করতে পারিনা তবে নিজেকে টিপটপ রাখার চেষ্টা করি যতটা সম্ভব…”
“হমম, সংসারের জন্য অনেক কিছুই ত্যাগ করতে হয় বল, তাতে নিজের খুশিও জলে ভাসিয়ে দেওয়ার পরও অন্যরা খুশি হয়না…” আমার কথা শুনে বৌদি আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কি যেন একটা ঠাহর করতে চেষ্টা করল তবে সেটা যে কি আমি বুঝতে পারলাম না । তারপর হঠাৎ বলে উঠল ঃ
“অ্যাই ওরকম দুঃখ দুঃখ কথা বলছ কেন গো? কিছু হয়ছে?”
“না, মানে এই তুমি তোমার সব সুখ নষ্ট করছ, তোমারও তো অনেক ইচ্ছে আছে যেগুলো পূর্ণ হয়না…”
“হ্যাঁ আছে বইকি, কিন্তু সমাজ তো সেসব ভালো চোখে দেখবে না…”
“সমাজকে মারো গুলি, সমাজ আমাদের জন্য কি করেছে ? নিজেদের যতই কষ্ট হোকনা কেন এই আকাঙ্খা গুল কে আমরা বিসর্জন করতে যাব কেন…?” আমি বলে উঠলাম ।
“বাবাহ! তুমি তো বেশ কথা বলতে জানো…”
“হমম…সেটা জানি কিন্তু রেখা, তুমি…তুমি আমার ওপর বিশ্বাস করতে পাড়…”
“জানি…তুমি যে আর পাঁচটা ছেলের মতন নও আর বিশ্বাসযজ্ঞ সেটা আমি জানি আর সেটা আমি অনেকদিন আগেই বুঝতে পেরেছি…আর তোমার ওপর ভরসা করতে পারব বলেই এসেছি আমি, নাহলে এর আগে আশপাস থেকে অনেক প্রলভনই এসেছিল আমার কাছে…” রেখা বৌদি বলে উঠল।