ইনভেস্টিগেটর

এখন রাত প্রায় দশটা, কোনভাবেই ঘুম থেকে ওঠার সময় নয়!”“তারমানে অসময়ে ঘুমিয়েছিলেন লোকটা! কাণ্ডজ্ঞানহীন!”, চট করে বলল রুপা!সামান্য বিরক্ত হয়ে, জোর গলায় বলল নির্জন, “মানে ভদ্রলোক হেভি ড্রিংকার- ডিহাইড্রেশনের কারণে মুখ ফুলেছে! সামনের দাঁতেও একটু ছোপছোপ দাগ! একটু অন্যভাবে ভাবতে শেখো, রুপা!”রুপা নির্জনের দিকে বাঁকা চোখে তাকাল। রুপার মুখের ভাব বুঝতে পারল না চোখদুটিই শুধু দৃশ্যমান থাকায়। নির্জনের ডিডাকশনে যে খুব বেশি ভরসা নেই ওর, বুঝতে পারল চাহনি দেখেই!রুপা বলল, “চারজন যাওয়ার কথা! বাকি দুজন কোথায়? এলো না যে?”নির্জন হাসল। বলল, “ওরা হয়তো আলাদাভাবে যাচ্ছে। জুলফিকার সাহেবের সন্দেহ যদি সঠিক হয়ঃ মিসেস জুলফিকার আর ঐ ভদ্রলোকের মধ্যে যদি সত্যিই এফেয়ার থাকে, তাহলে হয়তো এরমধ্যেই হানিমুন শুধু হয়ে গিয়েছে!”রুপা উঠল। কফি অর্ডারের নাম করে একবার দেখে এলো ওদের কেবিনটা। ফিরে এসে বলল, “না, এখনো দরজা লাগায়নি!”“লাগাবে!”, দ্ব্যর্থবোধক সকৌতুক গলায় বলল নির্জন। “লাগানোর জন্য সারাটা রাত বাকি!”হাসল বোধহয় রুপা, নির্জন দেখতে পেল না ওর মুখটা হিজাবের আড়ালে।পাখিদের উপর তাহমিনা হায়াতের গতবছর প্রকাশিত একটা গবেষণাপত্র পড়তে লাগল নির্জন। পরশু ওর ইউনির ওয়েবসাইট থেকে নামিয়ে প্রিন্ট করে নিয়েছে। কালও পড়েছিল রাতে ঘুমানোর আগে। খানিকক্ষণ বাদে বলল, “আমি তাহমিনা হায়াতের স্বামী হলেও জুলফিকার সাহেবের মতো সন্দেহ করতাম!”হিজাব সরিয়ে কফিতে চুমুক দিচ্ছিল রুপা। জিজ্ঞেস করল, “কেন?”“তোমার মেথডোলজি কোর্স ছিল অনার্সে?”, উল্টো প্রশ্ন করল ওকে নির্জন।“হ্যাঁ। থার্ড সেমিস্টারে।”“তাহলে তোমার জানার কথা, রিসার্চ মূলত দুই প্রকার। কোয়ালিটেটিভ আর কোয়ানটিটেটিভ, তাই না?”নিরুত্তর থেকে রুপা চুমুক দিল ধোঁয়া ওঠা কফিতে।“কোয়ালিটেটিভ রিসার্চ মূলত পর্যবেক্ষণ, অভিজ্ঞতা, অনুভূতি নির্ভর। কোনধরণের ম্যাথের, স্ট্যাটিস্টিকের প্রয়োজন হয় না। রিসার্চারের পর্যবেক্ষণই এধরণের রিসার্চের মূল। আসলে এসব কথাটা সিগারেট ছাড়া হয় না!”কথার মাঝে থেমে সিগারেট জ্বালল নির্জন ডলফিন কোম্পানির ম্যাচ জ্বেলে। দুতিনটা টান পরপর দিয়ে বলতে শুরু করল, “অন্যদিকে কোয়ানটিটেটিভ রিসার্চে স্ট্যাটিস্টিক বাধ্যতামূলক, এধরণের রিসার্চে সাধারণত তুলনা করে দেখানো হয়। আগের অবস্থা, বর্তমান অবস্থার পার্থক্য নির্ণয় করা হয়, পরিবর্তনের হার বের করা হয় ইত্যাদি! সায়েন্টিফিক রিসার্চগুলো হয় মূলত কোয়ানটিটেটিভ!”“এর সাথে তাহমিনা হায়াতকে সন্দেহ করার সম্পর্ক কী?”, অধৈর্য্য হয়ে জিজ্ঞেস করল রুপা!“কোয়ালিটেটিভ রিসার্চ সাধারণত সমাজবিজ্ঞান, দর্শন, ধর্ম, লিংগুয়েস্টিক ইত্যাদির জন্য ব্যবহৃত হয়। খারাপ বলছি না, তবে এই রিসার্চ পদ্ধতি অবৈজ্ঞানিক। কারণ এতে হিসেব নিকেশের কোন বালাই নেই। রিসার্চারের পর্যবেক্ষণ অনুভূতিই এখানে মুখ্য আর সেটা ভ্যারি করতে পারে রিসার্চারের মানসিকতা ভেদে! বাংলাদেশের বেশিরভাগ রিসার্চার এই কোয়ালিটেটিভ রিসার্চই করেন কারণ তারা স্ট্যাটিসটিক্স পারেন না!”“হ্যাঁ তো?”, ধৈর্য্যচুত্য রুপার প্রশ্ন।রুপার বিরক্তিকে পাত্তা না দিয়ে নির্জন বলেই চলল, “তাহমিনা হায়াতের এই রিসার্চটা কোয়ালিটেটিভ! তিনি তো সোশ্যাল সায়েন্সের রিসার্চার নন; ওরাও এখন কোয়ানটিটেটিভ রিচার্স করেন। তাহমিনা লাউয়াছড়ায় পাখিদের বাসস্থান আর পরিযায়ী পাখিদের নিয়ে গবেষণা করেছেন। প্রকাশও করেছেন সেটা। লিখেছেন, দিনদিন পাখিদের আবাস কমে যাচ্ছে। কিন্তু কী হারে কমছে, কোথায় কমেছে কিংবা আগে পরিযায়ী পাখিরা কী পরিমাণে আসত, এখন কী পরিমাণে আসছে, তার কোন হিসেব নাই! তাহলে কী করে বুঝব কমছে সংখ্যা? এমনকি পাখির সে ছবি লাগিয়েছে পেপারে, সেসব ছবিও তার তোলা নয়! কাল রিভার্স সার্চ করে দেখেছি, ছবিগুলো সব ফ্লিকার থেকে সংগ্রহ করা!”রুপার মুখটা এবারে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, বলল, “তারমানে দাঁড়াল…”রুপাকে কথা শেষ করতে দিল না নির্জন; জিজ্ঞেস করল, “সুন্দরবনের বাঘ গগনার উপায়টাকে কী বলে, জানো?”উত্তরের জন্য রুপার মুখের দিকে তাকাল নির্জন। ভ্রু কুঁচকে গেল রুপার। নির্জন বলল, “পাগমার্ক। পাগ মানে হিন্দিতে পা। পায়ের ছাপ চিহ্নিত করে বাঘ গণনা করা হয় বলে পদ্ধতিটাকে পাগমার্ক বলে। পাগমার্ক সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা না রেখেও বলে দিতে পারি, দিনদিন সুন্দরবনের বাঘের সংখ্যা কমছে! বলতে পারি, নদীতে শুশুকের, সমুদ্রে তিমির সংখ্যা কমছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাব তো পড়বেই প্রকৃতিতে! এজন্য কি গবেষণা প্রয়োজন? তাহমিনা ঠিকমতো গবেষণা করলে পরিযায়ী পাখিদের বাসস্থানের সংখ্যা, তাদের বিচরণভূমির পরিমাণ ইত্যাদি সংখ্যায় উল্লেখ করতেন।“থামল নির্জন। রুপার ওর দিকে তাক করে রাখা চোখের দিকে তাকিয়ে ছাড়ল একবুক ধোঁয়া। তারপর বলতে শুরু করল, “এস করেননি তিনি, কারণ জানেন না। এসব না করে, উল্টো ভূমিকায়, যে বহুজাতিক কোম্পানি তাদের সেই রিসার্চ স্পন্সর করেছিল, তাদের প্রশংসা করেছেন আধপাতা, সে কোম্পানির এমডিকে ধন্যবাদ জানাতে খরচ করেছেন কয়েকশো শব্দ! এটাকে গবেষণা বলে?”“আপনি তাহলে বলতে চাচ্ছেন”, রুপা বলে, “তাহমিনা আসলে গবেষণা করেননি?”নির্জন রুপার মুখের দিকে তাকাল, চোখ রাখল চোখে। বলল, “হ্যাঁ!”তারপর তাহমিনা হায়াতের কেবিনের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল, “আমি কোনভাবেই বার্ড ওয়াচার বাঁ পক্ষীবিশারদ নই! আমার কাছেই যদি এটাকে বোগাস মনে হয়, যারা এব্যাপারে এক্সপার্ট, তাদের কাছে এই গবেষণার মূল্য কতটুকু?”“বুঝতে পেরেছি!”, বলল রুপা। ট্রেন থেকে দেয়া লেপটাকে জড়িয়ে নিল শরীরে।নির্জনের মাঝেমাঝে মনে হয়, ওর একজন ডক্টর ওয়াটসন প্রয়োজন। এই যে এত বড় লেকচার দিল রিসার্চ নিয়ে, রুপা ছাড়া কেউ শুনল না! রুপাও হয়তো এ কান দিয়ে শুনে ও কান দিয়ে বের করে দিয়েছে- লিখে রাখা দূরে থাক!অবশ্য লিখে রাখার মতো কেইস’ই বা নির্জন পেল কোথায়!কোনান ডয়েলের লেখা নিয়ে সিনেমা হয়েছে প্রচুর। ফেলুদাকে নিয়ে সত্যজিৎ নিজেই সিনেমা করেছেন, এখনও সিনেমা হচ্ছে। গোয়েন্দা নির্জনকে নিয়ে সিনেমা হলে? হাসল নির্জন, “নির্মাতাকে ছবি থিয়েটারের বদলে পর্নহাবে মুক্তি দিতে হবে!”ট্রেন থামল বিমানবন্দর স্টেশনে। বাইরে চেঁচামেচি, ঠ্যালাঠেলি, গার্ডের হুইসেল, “এই মধু লাগবে মধু, সুন্দরবনের খাঁটি মধু”, ভিক্ষুক, “আল্লাহ’র নামে একটা টাকা দেন, বাজান!”কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো নির্জন। করিডোরে কেউ নেই। তাহমিনা হায়াতের কেবিনটা স্পষ্ট দেখা যায় এখান থেকে। এখনো কেবিনটাকে উন্মুক্ত রেখেছে ওরা। কতক্ষণ থাকে সেটাই দেখার বিষয়!আরেকটা সিগারেট জ্বালল নির্জন, করিডোরে দাঁড়িয়েই। সকালে সারাদিন সিগারেট ছোঁবে না- এমন ছেলেমানুষি পণ করেছিল! কেন, কে জানে! গোটা পৃথিবীতে নিকোটিন বিরোধী মুভমেন্ট চলছে। ছোটবেলায় দেখেছে, ট্রেনের সিটে বসেই দিব্যি সিগারেট খাচ্ছে লোকে। এখন দরজার কাছে এসে খেতে হয়; একটা স্মোকিং জোন পর্যন্ত নেই! নিকোটিন বিরোধী প্রচারণা এত বেশি যে, বিবিসির “শার্লোক” এ পরিচালক শার্লককে নন স্মোকার হিসেবে তুলে ধরেছে! বেনেডিক্ট ক্যামবারব্যাচকে একবারও পাইপ হাতে দেখা যায়নি। পাইপ ছাড়া শার্লোককে কল্পনা করা যায়?আবারও মিসেস জুলফিকারের কেবিনের দিকে আড়চোখে চাইল নির্জন। জুলফিকার সাহেব কাল ফোন করে জানিয়েছেন, শ্রীমঙ্গলে হোটেল নিসর্গতে থাকবে ওরা। তিনি নিজেই বুক করে দিয়েছেন দুটো রুম ফোন করে। রুম নাম্বার ৩০৭, ৩০৮। ট্রেন থেকে নেমে ওরা হোটেল নিসর্গতেই চলে যাবে সরাসরি। তিনতলাতেই রুম নেয়ার চেষ্টা করবে, না পেলে দেখবে অন্য ব্যবস্থা!ট্রেনটা চলতে আরম্ভ করল একটা দুলুনি দিয়ে। অজগরের মতো হেলতে দুলতে ছেড়ে যাচ্ছে বিমানবন্দর স্টেশনের প্লাটফর্ম। লোকজনের হাঁকডাক, ভিক্ষুকদের কাঁতর কণ্ঠ, গার্ডের হুইসেল, “সাবধানে”- সবকিছু মিলিয়ে গেল ইঞ্জিনের অবিরত শব্দে। হাঁটতে হাঁটতে পেরিয়ে গেলো তাহমিনাদের কেবিনে। এখন, ফোনের দিকে তাকিয়ে খুব হাসছে ওরা দুজন, মিসেস জুলফিকার হাসতে হাসতে ঢলে পড়ছেন ডক্টর মনোযার ওমরের গায়ে।ফোনটা ভাইব্রেট করতে শুরু করল নির্জনের পকেটে। সাইফা।“আগামী মাসে সুইডেন যাওয়া কনফার্ম মোমিনের! ভালোই হলো, এখন ঢাকার বাইরে যাচ্ছো তুমি! মোমিন সুইডেনে গেল আর তুমি ঢাকার বাইরে- কী অবস্থা হতো ভাবতে পারো?”, কুশলাদি বিনিময়ের পর বলল সাইফা। এখনো মোমিন আটকে আছে একটা অনুষ্ঠানে, ঘুমিয়েছে ছেলেটা।“কী আর হতো? তোমাকে চোদন না খেয়ে কয়েকটা দিন কাঁটিয়ে দিতে হতো!”, আশেপাশে তাকিয়ে বেশ নিচু স্বরে বলল নির্জন।“হুম।”“তোমার স্বামীকে বলো, সুইডেন থেকে ইম্পোর্টেড ভাইব্রেটর, ডিলডো নিয়ে আসতে। তাহলে আর কষ্ট করতে হবে না!”, হেসে বলল নির্জন।“আমার ওসব আর্টিফিসাল জিনিসে হয় না। আমার মানুষ চাই, বুঝলে। মানুষের বাড়া’ই চাই!”। বলল সাইফা হালকা গলায়।“তোমার এত খাই খাই হয়েছে কেন বলতো? বিয়ের আগেও এমন ছিলে?”“না গো!”, বলল সাইফা, “এখন যেন কেমন হয়ে গেছি! বিয়ের আগে তো চোদাচুদির কথা চিন্তাও করতাম না। তোমার সাথে দেখা হয়ে আমার এমন হয়েছে! আগে আমি কতো ভালো ছিলাম!”“আগে চুদতে ইচ্ছে করত না?”“করত না আবার!”, বলল সাইফা, “কিন্তু এখনকার মতো সারাদিন এসব নিয়ে ভাবতাম না!”কিছু বলল না নির্জন। দেখল, তাহমিনা হায়াত লেপ চাপিয়ে পা ছড়িয়ে লোয়ার বার্থে হেলান দিয়ে শুয়েছে, কানে লাগিয়েছে ইয়ারফোন। মনোয়ার ওমর ফোনে কথা বলছেন যেন কার সাথে, তার পায়ের কাছে বসে।“থাক সেসব কথা। আমার পরিকল্পনা শোন। আমি ভেবে দেখলাম, আমার লেখালেখি করা উচিত। সারাদিন তো বসেই থাকি, কী বলো?”নির্জনের মনে হলো, ভুল শুনছে ও। বলল, “কী করবে বললে? লেখালেখি?”“হ্যাঁ। সেদিন মোমিনের বিসিএস ব্যাচের অনুষ্ঠানে গেলাম না তোমার ওখান থেকে? অনেকের সাথেই কথা হলো! মোমিনের ব্যাচের অনেকের বৌ লেখালেখি করে। বইমেলায় বই ছাপায়, বই প্রকাশের অনুষ্ঠান করে, আত্মীয় বন্ধুবান্ধবদের গিফট করে। আমিও ভাবছি, বই লিখব, কী বলো?”এতোটা হতভম্ভ অনেকদিন হয়নি নির্জন। বলতেই পারল না কিছু! এমনকি ভুলে গেল মিসেস জুলফিকারের কেবিনের দিকে নজর রাখতেও।“কী? কথা বলছো না যে?”, ওপাশ থেকে তাগিদ সাইফার।“এটাই বাকি ছিল আরকি!”, বলল নির্জন। “আমলার স্ত্রী হয়ে বই প্রকাশ করবে না, তা আবার হয় নাকি? করে ফেলো!”খোঁচাটা ধরতে পারল না কিংবা গায়ে মাখল না সাইফা। বলল, “আমি কাহিনীও পেয়েছি একটা। শুনবে?”“কী কাহিনী শুনি!”“প্রেমের উপন্যাস আরকি। একটা ছেলে আর মেয়ের প্রেম! কিন্তু ছেলেটা গরীব। মা বাবা নেই। মেয়েটার বাবা বিসিএস ক্যাডার, মা ডাক্তার। মেয়ের মাবাবা কোনভাবেই তাদের প্রেম মেনে নেয় না। পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ওরা। অনেক কষ্ট হয় ওদের। ছেলেটা কারখানায় কাজ করে, মেয়েটা রান্নাবান্না করে। ওদের একটা বেবি হয়। সেই বেবিকে দেখতে পায় একদিন মেয়েটার বাবা। বাবার মন গলে যায়। উনি তখন মেনে নেয় বিয়েটা। ছেলেটাকে একটা ভালো চাকরি পাইয়ে দেয়। তারপর ওরা সুখে শান্তিতে ঘর করে!”নির্জনের মনে হতে থাকে, ওর কানে কেউ যেন ফুটন্ত তরল সীসা ঢালছে। হাসি ধরে রাখাও কষ্টকর হয়ে যায় ওর জন্য। কোনমতে হাসি সামলে, বলে, “বাঃ দারুণ গল্প! প্রেম আছে, ভালোবাসা আছে, বাঁধা বিপত্তি আছে আর আছে হ্যাপি এন্ডিং। জমে যাবে একদম!”“আমারও তাই মনে হচ্ছে! কিন্তু কাহিনীটা মোমিনকে শোনালাম। ও বলল, এমন নাকি অনেক গল্প আছে!”নির্জন বলল, উদ্রেক হওয়া অট্টহাসি আটকে, “লাখ লাখ প্রেমের গানও আছে, তাই বলে নতুন প্রেমের গান মানুষ লিখছে না? বিভূতিভূষণ প্রেমের গল্প লিখেছে, বুদ্ধদেব বসু লিখেছে, তুমিও ওদের দলে সামিল হলে!”“কার কথা বলছো? বুদ্ধদেব বসু? উনি খুব ভালো প্রেমের গল্প লিখেন, তাই না? আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে ওনার, অটোগ্রাফ নেব?”ফোনটা কেটে খ্যাখ্যা করে উচ্চগ্রামে হেসে উঠল নির্জন।

কেবিনে ফিরে এলো নির্জন। ট্রেন থেমেছে জয়দেবপুর স্টেশনে। রুপা বলল, “আপনি কোথায় শোবেন? উপরে না নিচে?”“উপরে! আমি সবসময় উপরে থাকতেই পছন্দ করি!”হাসল রুপা, ইঙ্গিতটা ধরল পারল কিনা কে জানে! বলল, “দরজাটা লাগিয়ে দিন তো! বোরখা পরে থাকতে ইচ্ছে করছে না আর। আমার অভ্যাস নেই একদম!”“তুমি বরং চেঞ্জ করে নাও, আমি বাইরে অপেক্ষা করছি”, বলল নির্জন ভদ্রতা করে।“দরকার নেই। শুধু বোরখাটা খুলব। আপনি কি মনে করেছেন, আমি এই শীতে বোরখার নিচে কিছু পরিনি?”ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল নির্জন। ও ভাবেনি এভাবে। ঠিক তখনই দরজায় টোকা মারল কেউ। রুপা তাকাল নির্জনের চোখে। ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল কিছু।একটু সময় নিয়ে, রুপাকে ঠোঁটে আঙ্গুল দিয়ে চুপ থাকর নির্দেশ দিয়ে দরজা খুলল নির্জন।“সরি, আপনাদের ডিস্টার্ব করলাম এই অসময়ে!”দরজার ওপাশে তাহমিনা হায়াত! জ্যাকেটের উপর কম্বল জড়িয়ে এসেছেন একটা।স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করল নির্জন। গলার স্বরটা স্বাভাবিকের চেয়ে মোটা করে, ভারি গলায় বলল, “সমোসসা নাই! কিছু কইবেন?”যথাসম্ভব পুরান ঢাকার টান গলায় আনতে চেষ্টা করল ও। নাকটা সামান্য কুঁচকে গেল তাহমিনার। আঞ্চলিকের কারণে?“আপনাদের কাছে কি নাইফ আছে? আই মিন, ছুরি? ফল কাটার ছুরি?”, বললেন তাহমিনা হায়াত।মাথা নাড়ল নির্জন। বলল, “না নাই! ট্রেনে কেউ ছুরিটুরি লইয়া আহে? আপনি এটেনডেনরে কইয়া দেখবার পারেন। হেরা হয়তো দিবার পারে!”“অহহ বুঝতে পেরেছি। আচ্ছা, গুড নাইট!”তাহমিনা হায়াত দাঁড়ালেন না আর, সম্পুর্ণ ইউটার্ন নিয়ে মন্থরগতিতে ফিরে চললেন নিজের কেবিনে।দরজায় দাঁড়িয়ে তার কোমর আর পাছার অপূর্ব মেলবন্ধন দেখতে লাগল নির্জন তিনি কেবিনে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয়া পর্যন্ত।“কী সুন্দরী!”, অস্ফুটে বলে উঠল রুপা! “এত সুন্দরী হয় কীকরে কেউ!”দরজা থেকে মুখ ফেরাল নির্জন। বলল, “শুধু সুন্দরী নয়, সেক্সিও!”“হ্যাঁ। আপনি তো হাঁ করে তাকিয়ে ছিলেন।“, বোরখা খুলতে খুলতে বলল রুপা।দরজাটা লাগিয়ে দিল নির্জন। “এত সুন্দরী মহিলার দিকে না তাকানোটা পাপ, জানো? আমরা ছেলেরা এডমায়ার না করলে, নারীদের সৌন্দর্যের মূল্য থাকে?”“আপনার ঢাকাইয়া গলা কিন্তু জোস! আমি পর্যন্ত কনভিন্সড হয়ে গেছিলাম যে আমি পুরান ঢাকার!”কিছু না বলে দরজা থেকে স’রে দাঁড়াল নির্জন।“উনি খুব রুপসচেতন, তাই না? চুল বাঁধার ধরণটা দেখেছেন? স্যাভেন্টিজে ববিতা এভাবে চুল বাঁধতেন!”, উদ্দীপ্ত গলায় বলল রুপা।“আর যাই দেখি, চুল অন্তত দেখিনি! অতোটা সভ্য আমার চোখ নয়!”হিহি শব্দ হেসে উঠল রুপা। নির্জনের মনে হলো, পাখি ডেকে উঠল দূরে কোথাও!সেফটিপিন আলগা করে হিজাব খুলল রুপা। ওর পরিচিত ম্যাডনা মুখ উদ্ভাসিত হলো নির্জনের সামনে। ওর মুখে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে নির্জন বলল, “তবে মিসেস জুলফিকারকে তোমার কাছে হার মানতে হবে। তোমার কাছে উনি কিছুই না!”চমকে নির্জনের দিকে তাকাল রুপা। সলজ্জ হাসে বলল, “যাহ্‌! কী যা তা বলছেন। উনি তো একদম শোবিজ কাঁপানো নায়িকার মতো দেখতে!”নির্জন তার ব্যাকপ্যাক খুলে একটা বই বের করল। বইয়ের পাতা কয়েকটা উল্টে, বুকমার্ক করা স্থানে গিয়ে বলল, “তোমার মতো গজদন্ত তার নেই। তুমি প্রতিবার হাসলে একটা করে কবিতা রচিত হয়!”“আপনি সবসময়ই বাড়িয়ে বলেন!”, অভিযোগের সুরে বলল রুপা। নির্জনের মনে হলো, প্রশ্রয়!“বাড়িয়ে বলছি না মোটেও। তোমার মুখ, তোমার গড়ন, হাসি- সবকিছুর মধ্যে ছন্দ আছে যেন। ভায়োলিনের সুমিষ্টি মূর্ছনার মতো! ফল করতেই হয়!”রুপার মুখ লাল হয়ে গেল। ও হয়তো কোনদিন সামনাসামনি কারো মুখ থেকে এমন প্রাণখোলা প্রশংসা শোনেনি।“আপনার হাতে ওটা কি বই?”, নির্জনের মুখ বন্ধ করতেই বোধহয় প্রসঙ্গান্তরে গেল রুপা!“আবুল হাসানের ‘যে তুমি হরণ করো’!”, বলল নির্জন। তারপর যোগ করল, “তবে। চোখের সামনে মূর্তিমতী কাব্য রেখে কার মন চাইবে কবিতা পড়তে?”“আপনার সাথে আর পারা গেল না!”, লেপ গায়ে মুড়ে বালিশে হেলান দিয়ে বলল রুপা। “আপনি এভাবে সব মেয়ের প্রশংসা করেন?”“না।”, সংক্ষেপে একশব্দে জবাব দিল নির্জন।নির্জন দেখল, রুপার গালের রঙ গাঢ়তর হয়েছে, যেন রক্ত জমতে শুরু করেছে গালে। কেউ যেন লাল রঙের ডিব্বায় ইজেল চুবিয়ে ছুঁইয়ে দিয়েছে গালে। তাকিয়ে রইল মুগ্ধ চোখে।কী মনে করে লেপ সরিয়ে উঠল রুপা। কেবিনের বাইরে বেরিয়ে ফিরে এলো আবার। অধরে* ঠোঁট কামড়ে হাসিমাখা মুখে বলল, “ওরা কিন্তু দরজা লাগিয়ে দিয়েছে!”“দেয়ারই কথা! সারারাত তো গেট খোলা রাখবে না!”, নির্জন বলল।“এতক্ষণে শুরু হয়ে গিয়েছে হয়তো!”, দুষ্টুমি হাসি ধরে রেখে বলল রুপা।বইটা রাখল নির্জন দুজনের মাঝখানে। বলল, “আমরাও লাগিয়ে দিয়েছি দরজা। অনেকেই হয়তো ভাবছে, আমরাও করছি!”চোখ নামিয়ে নিল রুপা। বলল, “তা বটে!”“তবে আমার মনে হয়”, মুখ তুলে বলতে লাগল রুপা, “আমাদের ইনভেস্টিগেট করার বেশি কিছু নেই। হোটেলে এরা দুজন আলাদা আলাদা রুমে থাকছে কিনা, জানলেই সবকিছু জানা হয়ে যাবে। আর ৪ জনের জন্য কেবিন নিয়ে যাচ্ছে মাত্র দুজন, এতেই তো অনেকটা বোঝা হয়ে যায়, তাই না?”“সেটা বড় কথা নয়। তাহমিনা হায়াতের এফেয়ারের ব্যাপারটা মনে হয়, জুলফিকার আমান ধরতে পেরেছিলেন। তার পেছনে আমাদের লেলিয়ে দেয়ার কারণটা হয়তো ভিন্ন!”“মানে?”, বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করল রুপা।“একটু মাথাটা খাটাও, অজিত। মস্তিষ্কটা ভগবান দিয়েছেন ভাবার জন্য, কাজে লাগাও!”সিনেমার ব্যোমকেশের গলা নকল করে বলতে চেষ্টা করল নির্জন। রুপা, হেসে ফেলে, বলল, “থাক! আপনাকে সত্যান্বেষী সাজতে হবে না আর। আপনি মানেটা বলুন!”“মানেটা হলো, প্রত্যেকটা মুসলিম বিয়েতেই মোহরানা ধার্য করা হয়, জানো তো? এই মোহরানা দেয়াটা স্বামীর দায়িত্ব। বেশিরভাগ সময়ই এই মোহরানা অল্প টাকা ধরা হয়। কোন কারণে বিয়ে ভেঙ্গে গেলে, স্বামী এই টাকাটা পরিশোধ করে ডিভোর্স দিয়ে দেয়। ভেজাল লাগে, যখন মোহরানার অংকটা বেশি হয়। ধরো ২০ লাখ কিংবা ১ কোটি, তখন স্বামী চাইলেও ডিভোর্স দিতে পারে না!”“হ্যাঁ তো?”“স্বামী সেসব ক্ষেত্রে স্ত্রীকে ডিভোর্স দিতে বলে। তালাকের সাথে যদিও মোহরের সম্পর্ক নেই, কিন্তু স্ত্রী ডিভোর্স দিলে এক্কেবারে টাকাটা না দেয়ার সম্ভাবনা থাকেই। আমার মনে হয়, জুলফিকার হায়াতও তাই চাইছেন। তিনি যদি তার স্ত্রীর পরকীয়ার প্রমাণ হাতে পান, তবে তিনি স্ত্রীকে বাধ্য করাতে পারবেন তাকে ডিভোর্স দিতে। তাকে আর মোহরানার বিশাল অঙ্কের টাকাটা দিতে হবে না!”“এভাবে তো ভেবে দেখিনি!”, বিস্মিত ঘোর লাগা গলায় বলল রুপা।“স্ত্রীর পেছনে ইনভেস্টিগেটর, মানে আমাদের নিয়োগ করতে তিনি প্রচুর খরচা করছেন। জুলফিকার আমান ব্যবসা করেন, রুপা! ব্যবসায়ীরা একটা টাকাও প্রোফিট ছাড়া ইনভেস্ট করেন না!”উপরের বার্থে উঠে এলো নির্জন। রিডিং ল্যাম্প জ্বালিয়ে চোখ চালিয়ে যেত লাগত কবিতার লাইন ধরে। মন বসাতে পারল না। এমন মৃদু ঘুমঘুম দুলনিতে কবিতার দুর্বোধ্য ছন্দ আর অন্তর্নিহিত অর্থে মনোযোগ দেয়াটা কষ্টকর।“আচ্ছা একটা কথা!”, নিচের বার্থ থেকে বলল রুপা!“আপনি আমার চেহারার আজ এত প্রশংসা করলেন কেন বলুন তো? আগেও তো আমাকে দেখেছেন কতবার! এভাবে বলেননি কোনদিন!”বইটা বন্ধ করে নির্জন বলল, “সুযোগ পাইনি হয়তো। তবে সুযোগ করে নেয়া উচিৎ ছিল!”কোন জবাব এলো না। ওকে নিরুত্তর থাকতে দেখে নির্জন বলল আবারও, “ইউ আর আ বিউটি, রুপা। ইউ সুড গেট ইউজড টু বিইং এডমায়ার্ড!”“চারটায় উঠতে হবে। ঘুমিয়ে পড়ুন। ঠিক সময়ে উঠতে না পারলে সকালে দেখব, আমরা শ্রীমঙ্গলের বদলে সিলেট পৌঁছে গেছি!”রিডিং লাইটটা নিভিয়ে দিল নির্জন। এবারে অন্ধকার- চার্জার পোর্ট থেকে আলো আসছে শুধু। নিচের বার্থ থেকে রুপার নিঃশ্বাসের শব্দ আসছে কানে। চোখ বন্ধ হয়ে এলো ওর। প্রস্তুতি এখন সাময়িক মৃত্যুর।****সকালের আলো ভালো মতো ফোটার আগেই, যখন পাখিরা উসখুস করছে নীড়ে, ঘুমঘুম শ্রীমঙ্গল স্টেশনে ঢুকল উপবন এক্সপ্রেস। একঘণ্টা আগেই ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে নিয়েছে ওরা। রুপার মুখ ঘুমকাঁতর- ফুলে আছে চোখদুটো। নির্জন মাথা মুখ পেঁচিয়ে নিয়েছে পুরু মাফলারে। ঠিক করেছে, ওয়েটিং রুমেই খুলে ফেলবে মুখ থেকে অস্বস্তিকর ফ্রেন্সকাট আর আচুল।শ্রীমঙ্গল স্টেশনে খুব বেশি লোক নামেনি ট্রেন থেকে। তাহমিনা হায়াত আর সেই অধ্যাপক, কয়েকজন কমবয়সী ছাত্রছাত্রীর একটা গ্রুপ আর ওরা দুজন।তাহমিনা হায়াত আর সেই অধ্যাপক ট্রেন থেকে নেমেই স্টেশন ত্যাগ করলেন- হয়তো গেলেন সিএনজির খোঁজে।রুপা বলল, সেদিকে তাকিয়ে, “আমরা এখন ওদের সাথে যাবো? পিছে পিছে?”“না”, বলল নির্জন। “জানি, ওরা কোথায় যাচ্ছে। বেকার ফলো করার কী দরকার। এখানেই চেনজ করে নেব দুজনই। তারপর ধীরেসুস্থে চারপাশটা দেখতে দেখতে হাজির হবো হোটেলে!”বেশ বড় স্টেশন, জেলা শহর হিসেবে। প্ল্যাটফর্মের এখানে ওখানে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়েছে অনেকেই; এরা মূলত ভিখারি। কুয়াশায় রহস্যাবৃত চারদিকটা- দশ হাত দূরের জিনিসও ঠিকঠাক চোখে আসছে না। সারারাত জ্বলে ক্লান্ত হয়ে যাওয়া আদিকালের লাল বাল্বগুলো জ্বলছে সহস্রাব্দী আগেই মরে যাওয়া আলোকবর্ষ দূরের নক্ষত্রের মতো, মিটমিট করে।ওয়েটিং রুমে এসে চেঞ্জ করল ওরা। নির্জন গুলিস্তানি কোটটা খুলে গায়ে চাপাল গতবছর ট্যানারি মোড় থেকে অর্ডারে বানিয়ে নেয়া চামড়ার জ্যাকেট, পায়ে গলিয়ে নিল এপেক্সের জুতা; ঢোলাঢালা প্যান্ট বদলে, পরল গ্যাবারডিন।রুপা বোরখা খুলে স্বাভাবিক পোশাকে প্রত্যাবর্তন করেছে। একটা উলের টুপিতে ঢেকে রেখেছে কান- আরো বেশি আদুরে আর কমবয়সী লাগছে লাগছে ওকে।“এক কাপ চা পেলে মন্দ হয় না, কী বলো?”, ব্যাকপ্যাকটা কাঁধে নিয়ে বলল নির্জন।রুপার মুখে ঘুম কম হওয়ার ক্লান্তি। কিন্তু চোখদুটো পাখির মতোই চঞ্চল- সজীব। কয়েকবার পলক ফেলে, চুখদুটো টার্বাইনের মতো ঘুরিয়ে, বলল, “জমে যাবে একদম। চায়ের রাজধানীতে এসেছি, দেখা যাক, কেমন চা বানায় এরা!”স্টেশন থেকে বের হতেই ওদের ঘিরে ধরল সিএনজিওয়ালারা। লাউয়াছড়া, মাধবপুর লেক, হামহাম ঝর্ণা- সব একদিনেই দেখিয়ে আনতে ওরা কত নেবে, আলাদা আলাদা করে যেতে কী কী সমস্যা, সবিস্তার বলতে লাগল একসাথে।নির্জন ওদের পাত্তা না দিয়ে এলো একটা চায়ের দোকানে। “তুমি চাঁদের জোছনা নও, ফুলের উপমা নও, নও তুমি পাহাড়ি ঝর্ণা”- এন্ড্রু কিশোরের মহুয়া কণ্ঠের গানটা বাজছে সাউন্ডবক্সে, এমন কাকভোরেও। দিনের প্রথম সিগারেট জ্বালিয়ে, চায়ে চুমুক দিয়ে বলল, “তুমি তো এর আগে এসেছিলে একবার, তাই না?”“হ্যাঁ। সীমান্তের সাথে।““সীমান্তের সাথে ব্রেকাপ হলো কেন?”প্রশ্নটা করা যে ঠিক হয়নি, বুঝতে পারল কথাগুলো উচ্চারিত হওয়ার পর। বন্দুকের গুলি আর মুখের কথা- সিগারেটে টান দিল নির্জন।“বনিবনা হচ্ছিল না!”, খুব বেশি গুরুত্ব না দিয়ে সংক্ষেপে বলল রুপা।“আমাদের টিএসসির চা আর এই চায়ের তো দেখি কোন পার্থক্য নেই!”, অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ চাপা দিয়ে বলল রুপা।উত্তরটা দিল চাওয়ালাই। বলল, “আমরাও প্যাকেটের চা’ই বেচি। চা সারাদেশেই এক!”চা শেষ করে বেশ কিছুক্ষণ দরাদরি করে একটা সিএনজি ঠিক করল নির্জন। সিএনজিতে উঠেই বলল, “লাউয়াছড়া কথা উঠলেই সবাই শ্রীমঙ্গলের কথা বলে। ওটা কিন্তু আসলে কমলগঞ্জ উপজেলায় পড়েছে!”ঘুমন্ত শ্রীমঙ্গল শহর পেরিয়ে ফাঁকা রাস্তায় এসে পড়ল ওদের সিএনজি। কুয়াশা কাটতে শুরু করেছে, সুর্যের কোমল শিশুরশ্মি হামলে পড়ছে পথের গাছগুলোর ঘন সবুজ, হলুদ সবুজ, হালকা নীল পাতায়। বাড়িঘর খুব বেশি চোখে পড়ছে না। কিছু দূরে দূরে সাইনবোর্ডে টুরিস্ট পুলিশের নাম্বার দেয়া। কিছুক্ষণের মধ্যেই চা বাগান চোখে পড়ল ওদের।রুপা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, “কী সুন্দর তাই না? মনে হচ্ছে সবুজ উঁচুনিচু গালিচা!”নির্জন হাসল। বলল, “চাবাগান দেখে আনন্দিত হওয়ার কিছু নেই। চা বাগান না থাকলেই বরং ভালো হতো!”বিরক্তি নিয়ে নির্জনের দিকে তাকাল রুপা। বলল, “আপনি সবকিছুই একটু বেশি বোঝেন আর জানেন!”“তা একটু বুঝি আর জানি বটে! একারণেই তোমার মতো সবকিছুতে উদ্বেলিত হতে পারি না! নোইং, সামটাইমস, ইজ আ কার্স!”বাইরে থেকে চোখ ফিরিয়ে রুপা নির্জনের দিকে তাকিয়ে বলল, “কী বেশি জানেন আর বোঝেন, শুনি?”“চা বাগান নিয়ে তোমার রোম্যান্টিসিজম নষ্ট করতে চাই না”, হেসে বলল নির্জন। “তুমি দেখ!”কৌতুক বোধ করল নির্জন রুপার বিরক্ত মুখ, সংকুচিত চোখ দেখে।“না বলুন আপনি! আমি শুনব!”, জেদ ধরে বলল ও।“দেড়শো বছর আগেও বাঙ্গালীরা চা খেতে জানত না, জানো তো? ঐ সময়কার সাহিত্যে চায়ের উল্লেখ নেই! সেসময়ে ইউরোপে, বিশেষকরে ইংল্যান্ডে চায়ের প্রচণ্ড চাহিদা। ইংরেজরা তখন ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে চা চাষ শুরু করে। পাহাড় সাফ করে চা বাগান করা হয় এসব অঞ্চলে। সেসব পাহাড়ে প্রাকৃতিক জঙ্গল ছিল, বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল ছিল, অনেক আদিবাসী গোষ্ঠীর বাস ছিল। আস্তে আস্তে সব ধ্বংস হয়ে গেছে। এখন এ অঞ্চলে বন্যহাতি দেখাই যায় না! কতধরনের বেড়াল ছিল- মর্মর বেড়াল, মেছো বেড়াল- সেসব দেখতে হলে এখন চিড়িয়াখানায় যেতে হচ্ছে। কত পাখি নেই হয়ে গেছে। এখনো যা টিকে আছে, বনজসম্পদ আর বনভূমি- সেসবও ধ্বংস হয়ে যাবে পর্যটনের চোদনে, দেখে নিও।”বেশ বড় একটা বক্তৃতা দিয়ে থামল নির্জন। রুপা পুরোটা সময় তাকিয়ে ছিল ওর মুখের দিকে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “ঠিক বলেছিলেন আপনি! নোইং ইজ আ কার্স! আমি এসব নিয়ে ভাবতে চাইনা। ভবলে তো সেসব হারিয়ে যাওয়া প্রানী ফিরে আসবে না!”“ভাবলে সেসব প্রাণী ফিরবে না বটে, তবে নতুন করে কোন প্রজাতি বিলুপ্ত হবে না!”, সামান্য হেসে বলল নির্জন।কিছুক্ষণের মধ্যেই ওরা পৌঁছে গেল ‘নির্সগে’।লজটা মূল রাস্তা থেকে বেশ কিছুটা দূরে নির্মিত। সুড়কির পথের দুপাশে চা বাগান। মূল ফটকে উর্দিপরা দারোয়ান। লজের কোজি ভাবের বদলে, কর্পোরেট ভাবটাই প্রকটভাবে প্রকাশিত।রিসেপশনে গিয়ে নির্জন তিনতলায় কোন রুম ফাঁকা আছে কিনা জিজ্ঞেস করতেই রিসেপশনিস্ট, এজ এক্সপেক্টেড, ঘষামাজা ময়দামাখা তরুণী- ইংরেজি বাংলা মিশিয়ে, র’কে ড় উচ্চারণ করে, হাস্কি গলায় হেসে, বলল, “সড়ি, স্যাড়। তিন তলাড় কোন ড়ুম ভ্যাকেন্ট নেই। তবে দুপুড়ে হতে পাড়ে। একজন গেস্টকে আমড়া এক্সপেক্ট কড়ছি, দুপুড়েড় মধ্যে উনি না এলে আপনাড়া সেখানে শিফট কড়তে পাড়বেন।““এখন কত তলায় রুম ফাঁকা আছে?”, জিজ্ঞেস করল নির্জন।“দুই তলায়, স্যাড়! আপনি কি কাইন্ডলি জানাবেন, কতদিন স্টে কড়ছেন আপনি আর আপনাড় ওয়াইফ?”“ওয়াইফ নয় কলিগ! আমরা বিবাহিত নই!”, বলল নির্জন। ভুলটা ভেঙ্গে দেয়ার কোন দরকার ছিল না যদিও। তারপর বলল, “বেশ কয়েকদিন থাকব, যদি তিন তলায় রুম পাই!”“ওহ! সড়ি, স্যাড়। আমি ভেবেছিলাম, আপনারা কাপল!”মেয়েটির দিকে তাকাল নির্জন। পাহাড় দর্শন হয়ে গেল, ওর দিকে তাকাতেই। মুখে রাত জাগার ছাপ, ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক, বেশ স্ফিত ঢলঢলে শরীর।কয়েকটা ফর্ম, ফিল আপ করে অগ্রিম দুদিনের ভাড়া পে করল নির্জন। একজন বয় ওদের মালমত্র বয়ে নিয়ে গেল দুইতলার রুমে।সেলাম ঠুকে বয় বিদায় নিলে, বাথরুমে ফ্রেস হতে গেল রুপা। ও ফিরে এলে গরম পানি দিয়ে গোসল করে নিল নির্জন। ট্রেনের দুলনি ভাবটা কেটে গেল তাতে।বাথরুম থেকে বেরিয়ে কাঁপতে কাঁপতে এসে ঢুকে পড়ল লেপের ভেতর। রুপা বসে আছে খোলা জানলায় মাথা রেখে। বিছানার সাথেই কাচের বিশাল জানলা। সকালের কাঁচা রোদ গুটিসুটি মেরে আছে বিছানায়, পোষা বেড়ালের মতো।নির্জনের দিকে ফিরে স্বভাবসুলভ উচ্ছ্বসিত গলায়, বলল রুপা, “একদম স্বপ্নের মতো লাগছে, জানেন? জানলায় বসেই চা বাগান দেখা যাবে! সীমান্ত যে হোটেলে নিয়ে গিয়েছিল, ওটা শ্রীমঙ্গল শহরের ভেতরে। জানলা দিয়ে কিছুই দেখার ছিল না!”রুপার গালে রোদ পড়েছে, সোনা আলো ঝিলিক মারছে ওর বরফসাদা গজদন্তে। নির্জন বলল, “সেবারে কী চাবাগান, পাহাড়, লেক, ছড়া দেখার সুযোগ পেয়েছিলে? নাকি সীমান্ত বিছানা থেকেই নামতে দেয়নি?”“আপনি না?”, লজ্জিত মুখ নিচু করে বলল রুপা।“খুব মিথ্যে বললাম? আমি তোমার বফ হলে অন্তত তাই করতাম! ছাদ ছাড়া আর কিছু দেখা হতো না তোমার!”, তরল গলায় বলল নির্জন।“আপনার মুখে কিছুই আটকায় না! একদম বেশরম আপনি!”, বাইরের দিকে তাকিয়ে অভিযোগ করল রুপা।তারপর ওর দিকে চোখ ফিরিয়ে বলল, “প্রথম দুদিন অবশ্য আসলেই ঘর থেকে বের হয়নি। বিকেলে শুধু একটু বাইরে পায়চারী করতাম। তারপর অবশ্য মাধবপুর লেক, হামহাম এসব ঘুরে ঘুরে দেখেছি!”বাইরে তাকাল নির্জন। জীবন হয়নি শুরু এখনো এই সুন্দর ছিমছাম পাহাড়ি শহরে। চা বাগানের ফাঁকেফাঁকে লাগানো নিমগাছগুলোর ডালে সূর্যের কচি আলোয় কয়েকটা শ্যামা দোল খাচ্ছে- ডাকছে- উড়ে যাচ্ছে ফুড়ুৎ করে চোখের আড়ালে।শুয়ে পড়ল নির্জন। নিশ্ছিদ্র একটা ঘুমের প্রয়োজন ওর। দুপুর পর্যন্ত ঘুমিয়ে কাটাল ওরা। নির্জনের ঘুম ভাঙল সুপ্রভার কলে!“আজ জুলফিকার সাহেব এসে যা কাণ্ড করেছে, জানেন না!”, ফোন রিসিভ করতেই কথাগুলো বলতে শুনলো সুপ্রভাকে!ঘুম জড়ানো কণ্ঠে নির্জন বলল, “কী কাণ্ড আবার করল!”“আজ দশটার দিকে অফিসে এসেছিলেন। এসে বললেন, উনি আর চান না আমরা ওর স্ত্রীকে নিয়ে ইনভেস্টিগেশন করি! উনি টাকাটা ফেরত চান!”ঘুম কেটে গেল নির্জনের। ও দেখল, লেপের নিচ থেকে গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছে রুপা। বলল, “তুমি কী করলে!”“কী আবার!”, বলল সুপ্রভা, “বললাম, টাকাটা অফেরতযোগ্য! তাছাড়া দুজন ইনভেস্টিগেটর অলরেডি চলে গিয়েছে শ্রীমঙ্গলে। তবে আমরা আপনি যেহেতু বলছেন, আর ইনভেস্টিগেশন চালাব না!”“উনি কী বললেন?”“প্রথমে একটু শাসিয়েছেন। যা হয় আরকি, এটা করব ওটা করব। পরে আমি কিছু শক্ত কথা বলাতে চুপ হয়ে গেলেন। আমরা যেন আর কোন মুভ না করি, এই কথাটা বারবার বলে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেলেন!”“অদ্ভুত ক্যারেকটার! ঠিকই বলেছিলে তুমি!”, গম্ভীর গলায় বলল নির্জন।ফোন রাখতেই রুপা জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে? এমন গম্ভীর হয়ে গেলেন!”ফোনের স্ক্রিনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল নির্জন। বলল, “আমাদের শ্রীমঙ্গলে আসাটা অফিসিয়ালি ‘ট্যুর’ হয়ে গেল!”“মানে? ইনভেস্টিগেশন ক্যান্সেল?”, অবাক গলায় বলল রুপা!“তাই তো বলল সুপ্রভা। জুলফি সাহেব নাকি সুপ্রভার অফিসে এসে সবকিছু বন্ধ করতে বলেছেন!”“তাহলে তো ভালোই হলো! আমরা ঘুরে টুরে চলে যাব। ওর জন্য আমাদের শ্রীমঙ্গলে আসাটা তো হলো!”, খুশী খুশী গলায় বলল রুপা।নির্জন তাকাল রুপার সদ্য ঘুম থেকে ওঠা নির্মল মুখের দিকে। চোখে মুখে ভালো ঘুম হওয়ার প্রশান্তি, ভিজে আছে ঠোঁট। বলল, “আমার কেন জানি না, ব্যাপারটাকে গোলমেলে মনে হচ্ছে। টাকা ফেরত পাবেন না জেনেও, নিজের বৌয়ের পেছনে লোক লাগিয়ে আবার সেটা বন্ধ করালেন! কী কারণ থাকতে পারে এর?”“মন পরিবর্তন হতে পারে না? আপনি ব্যাপারটাকে এত জটিলভাবে নিচ্ছেন কেন?”, উঠে বসে বলল রুপা।ঠিক তখনই দরজায় নক করল কেউ। বিছানা ছাড়তে সময় নিল নির্জন। বেশ ঠাণ্ডা রোদ উঠলেও, সদ্য ঘুম থেকে উঠে কার ইচ্ছে করে বিছানা ছাড়তে? ওর তাড়া নেই কোন!দরজা খুলতেই ফর্মাল পোশাক পরিহিত একজনকে দেখতে পেল নির্জন।“গুড আফটারনুন, স্যার। আমি এই হোটেলের চিফ স্টাফ কোঅর্ডিনেটর, বাদল ব্যানার্জি। আপনারা রুম পরিবর্তন করবেন বলে বলেছিলেন। আমাদের তিন তলায় একটা রুম ফাঁকা হয়েছে। সেই রুমে আপনারা শিফট করবেন?”“চিফ স্টাফ কোঅর্ডিনেটর” শব্দটা নিয়ে খেলল কিছুক্ষণ নির্জন। এর মানেটা আসলে কী? প্রধান কর্মচারি সমন্বয়কারী?লোকোটা বেটে, গোলগাল। ছাদে মাল কম আছে, ক্লিন সেভড।“তিন তলায় বিছানার পাশেই জানলা আছে? জানলা দিয়ে চা বাগান দেখা যায়?”, নির্জন কিছু বলার আগেই কথাগুলো বলল রুপা।“অবশ্যই, ম্যাম! তিন তলার রুমগুলো বরং নিচের দুটো ফ্লোরের চেয়ে অনেক ভালো, যদিও ভাড়া একই। হট ওয়াটার সুইমিং পুলটাতও তিন তলাতেই।““তাহলে চলুন! দেরি কেন?”*****রুম নাম্বার ৩০৯! জুলফিকার আমান জানিয়েছিলেন, তিনি তাহমিনা হায়াত এন্ড কোং এর জন্য ৩০৭ আর ৩০৮ নম্বর রুম বুক করেছেন। তবে কি তাদের পাশের রুমেই থাকছে নির্জনেরা?এর আগে বেশ কয়েকবার টার্গেটকে ফলো করতে হোটেলে থাকতে হয়েছিল তাকে, কোনবারই একদম পাশের রুম ফাঁকা পায়নি। আজ পেল কিন্তু তার আগেই মিশন টার্মিনেটেড! ভাগ্যের পরিহাস বলতে হবে!৩০৭ ও ৩০৮ নম্বর রুম তালাবন্ধ। খটকা লাগল নির্জনের। তবে কি তাহমিনা হায়াত আর তার সহকর্মী আসেনি এই হোটেলে? নাকি বাইরে চলে গেছে এর মধ্যেই?রুমের ভেতরে ঢুকে রুপা বলল, “আসলেই দুই তলার চেয়ে রুমগুলো বেটার। স্পেস অনেক বেশি! আমার তো এখানেই থেকে যেতে ইচ্ছে করছে!”লাঞ্চ করে বেরিয়ে পড়ল ওরা। নির্জন ভেবেছিল, রুপা তৈরি হতে ঘণ্টাখানেক সময় নেবে। ওকে ভুল প্রমাণ করে, ১৫ মিনিটেই তৈরি হয়ে নিল সে।সূর্য এর মধ্যেই হেলে পড়েছে অনেকটা, শীতের কোমল সূর্যরশ্মি তির্যকভাবে পড়ছে ওদের চোখে মুখে।“আনপপুলার অপিনিয়নঃ ঘোরাঘুরির জন্য শীতকালের চেয়ে গরমকালটাই ভালো। বিশাল একটা দিন পাওয়া যায়। শীতে দিন ছোট- আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সূর্য ডুববে। অন্ধকারে শ্রীমঙ্গল আর সাভারের মধ্যে তফাত কী?”লাউয়াছড়ার দিকে সিনএনজিতে যেতে যেতে কথাগুলো বলল নির্জন। রুপা ওর প্রায় গা ঘেঁষে বসেছে, সুমিষ্টি মৃদু গন্ধ আসছে পারফিউমের। চুল ওর চুড়ো করে বাঁধা- কানের দুপাশে কয়েক গোছা চুল তবু দুলছে অবাধ্যের মতো।“সেটা ঠিক। তবে গরমে খুব ঘাম হয় আমার! আর ঘামের গন্ধ অসহ্য!”“আমার ঠিক বিপরীত!”, বলল নির্জন, পথের দিকে তাকিয়ে।“প্লিজ বলবেন না, ঘামের গন্ধ আপনার প্রিয়!”, ওর দিকে মুখ করে বলল রুপা, অবাধ্য চুলের গোছাকে কানে গুঁজে।নির্জন হাসল। বলল, “নিজের ঘামের গন্ধ? সেটার কথা বলছি না! কিন্তু বিপরীত লিঙ্গের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা আলাদা। কিশোরীর ঘর্মাক্ত দেহের তীব্র কটু গন্ধ বর্ষার সোঁদা মাটির অস্ফুট ঘ্রাণের তার চেয়ে রমণীয়। তুমি বুঝবে না!”“ইয়াক! গ্রোস”, বলল রুপা, চোখ মুখ কুঁচকে। “আজ থেকে কী করব, জানেন? একটা শিশিতে আমার ঘাম ভরে আপনাকে দেব প্রতিদিন। আমার অতিরিক্ত ঘামের অন্তত একটা সদ্ব্যবহার হবে!”উচ্চগ্রামে হেসে উঠল নির্জন। ওর অকস্মাৎ তারা সপ্তকের হাসিতে সিএনজিওয়ালা পর্যন্ত তাকাল পিছনে ফিরে।লাউয়াছড়ার গেটে সিএনজি থেকে নামতেই তাহমিনা হায়াতকে দেখতে পেল নির্জন। “লাউয়াছড়া ন্যাশনাল পার্ক” লেখা একটা নামফলকের সামনে দাঁড়িয়ে পোজ দিচ্ছেন একটা কমবয়সী মেয়ের- হয়তো ওর ছাত্রী, কাঁধে হাত রেখে। বাইশ তেইশ বছরের একজন তরুণ ক্যামেরা হাতে ছবি তুলছে ওদের। একই জায়গায় দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকটি ছবি তুলে নিল ছেলেটি বিভিন্ন ভঙ্গিমার।অধ্যাপক মনোয়ার ওমরকে সে দেখতে পেল না কোথাও।তাহমিনা হায়াতের সাথের মেয়েটিকে চেনা চেনা লাগল নির্জনের। কোথাও দেখেছে কী? টিভিতে, পত্রিকার ক্রোড়পত্রে কিংবা ইন্সটাতে? মনে করতে পারল না।মেয়েটির ফুলস্লিভ হুডি আর টাইট সোয়েটপ্যান্ট যেন আটকে রেখেছে আগ্নেয়গিরি। “চির উন্নত শির” স্তনদ্বয় প্রচ্ছন্ন প্রকাশিত, নিতম্ব মহাদেশসম। চোখ সরিয়ে নিল নির্জন- এই মুহূর্তে ও চায়না অন্তর্বাসের নিচে ঘুমিয়ে থাকা কেঁচোটা নড়েচড়ে উঠুক!টিকিট কেটে ভেতরে ঢুকল ওরা। পথের দুদিকে আকাশছোঁয়া বনস্পতি সূর্যের আলো চুষে নেয়ার প্রতিযোগিতায় মত্ত- আকাশে মাথা তুলবার কী প্রাণবাজি চেষ্টা! পথের দুপাশের ছোটছোট পাহাড় বেয়ে ঘন ঝোপের জঙ্গল। গাছগুলোর কাণ্ডে নামফলক টাঙ্গিয়ে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়েছে। পশুর, শাল, অর্জুন, দেবদারু, সেগুন- এই কয়েকটি মাত্র গাছই শুধু পরিচিত ওর। গাছগুলোর নাম পড়তে পড়তে এগিয়ে গেল নির্জন।কানে বাজছে পাতা ঝরার ব্যাকগ্রাউন্ডে অচেনা অদেখা পাখির রিংটোন। কতদিন পাখির কাঁতর কণ্ঠ শোনেনি ও! হয়তো শুনেছিল গতজন্ম! পাখির ডাক শোনার দিনগুলি কি শেষ হয়ে গিয়েছে?মূল ফটক থেকে কিছু দূরে, বেশ কয়েকটা দোকান পাহাড়ের ওপর, জঙ্গলের মাঝে; দোকানগুলো কাঠ আর বাঁশ দিয়ে তৈরি। খুব বেশি লোক নেই। যারা এসেছে, তাদের মধ্যে অনেকেই ক্লান্ত- চা সিগারেট খাচ্ছে।“এটা তো পার্ক নয়, রীতিমত সংরক্ষিত বনাঞ্চল, এখানে এমইউজমেন্ট পার্কের মতো দোকানটোকান থাকবে কেন?”, উচ্চারণ না করে, নিজেকেই প্রশ্ন করল নির্জন।পথে পড়ে থাকা বৃদ্ধ পাতাগুলো সুষম গতিতে মাড়িয়ে যেতে যেতে বনের অনেকটা ভেতরে প্রবেশ করল ওরা। হঠাত ঘুঘুর দূরাগত ডাক শুনুতে পেল নির্জন। হাজার অচেনার পাখির কূজনের মধ্যে ঘুঘুর ডাক শুনে ভালো লাগল ওর। অজানা অচেনা দেশে, হুট করে দেশের কাউকে খুঁজে পাওয়ার অনুভূতি হলো ওর।প্রকৃতির এই ধ্যানমৌন পরিবেশ নিশ্চুপ করে দিয়েছে ওদের চার ঠোঁটকে।হঠাত হাসির শব্দে চমকে পিছনে ফিরে তাকাল নির্জন। দেখল, ক্যামেরা হাতের ছেলেটা তাহমিনা হায়াতের কোন কথায় ঢলে পড়তে হাসতে হাসতে। মেয়েটির মুখও হাসি হাসি। তাহমিনা হায়াত হাত নাড়িয়ে বলছেন কিছু, বেশি উত্তেজিত হয়ে।ডানা ঝাপটানোর ফরফর আওয়াজ এলো কানে। দেখল, একটা প্যাঁচা উড়ে গেল ভয় পেয়ে। নির্জন দাঁড়িয়ে পড়ল। রুপাও।সদর্প হেঁটে পাশ কাঁটিয়ে যাওয়ার সময়, নির্জন শুনল, মেয়েটা বলছে, “কাপলদের জন্য পার্ফেক্ট প্লেস, যাই বলুন। এর চেয়ে ভালো ডেটিং স্পট আর হতেই পারে না!”“ইউ নো ইট বেস্ট, পারিজা। ইউ আর এক্সপার্ট অন ডেটিং!”, হাস্যতরল গলায় বললেন মিসেস জুলফিকার।ছেলেটা এই কথাতেও হাসতে লাগল মাথা দুলিয়ে, খ্যাকখ্যাক করে।শক্ত হয়ে এলো নির্জনের মুখ। এই জায়গাগুলোয় সশব্দে হাসিহাসির জন্য ৫০০ টাকা জরিমানা থাকা উচিত অন্তত। প্রকৃতির মধ্যে এসে কান পেতে পাতা ঝরার শব্দ, পাখির ডানা ঘষার শব্দ শুনতে না চাইলে আসার দরকারটা কী? হাসাহাসির তো অনেক জায়গাই আছে! এ ধরণের লোকেরাই পাহাড়ে জঙ্গলে এসে ভিড় করছে বেশি। তাদের জন্যে তৈরি হচ্ছে, পাহাড় কেটে, জঙ্গল সাফ করে কটেজ, হোটেল, লজ। বেনিয়াবৃত্তি শুরু হয়েছে প্রকৃতির মাঝেও।“শান্তি শান্তি!”, নিজেকেই বলল নির্জন। এদের উপর রাগ করে মনটাকে বিচলিত করার মানে নেই, বিশেষত এখানে, এই শতবর্ষী সন্ত গাছগুলোর ছায়ায়।কিছুদূর গিয়েই লাউয়াছড়ার বিখ্যাত রেললাইন দেখতে পেল ওরা। দুপাশের চিরসবুজ বৃক্ষের পাহাড় চিরে ঋজু রেললাইন চলে গিয়েছে দূরে একটা নিয়ে। লাইনের উপরে ঝুঁকে আছে গাছগুলো, আশীর্বাদের ভঙ্গিতে, রোদ এসে পড়েছে পাতায়। চারিদিকে গাছপাতার নিছিদ্র ব্যারিয়ার, হাওয়া চলছে শুধু লাইনটা ধরেই; দুলিয়ে যাচ্ছে গাছের স্থির মৌনী উজ্জ্বল পাতাগুলোকে।“এই রেললাইন ধরে অনেকদূর হেঁটে গিয়েছিলাম আমরা!”ভেতরে ঢোকার পর এই প্রথম মুখ খুলল রুপা। কথাগুলো বলল উদারায়, যেন গুনগুণ করল আপনমনে।“ওর হাত ধরে লাইনের উপর হাঁটছিলাম, কথা বলতে বলতে। এত ভেতরে চলে গিয়েছিলাম রেললাইন ধরে, বুঝতেই পারিনি!”স্পষ্ট দীর্ঘশ্বাস শুনতে পেল নির্জন। পাতাকাটা একফালি রোদ ওর মুখে। কিন্তু দীর্ঘ ছায়া ওর চোখের পাতায়, গালের একা তিলে। ঠোঁটদুটো কাঁপছে হালকা তিরতির হাওয়ায় শুকনো সুপারি পাতার মতো।“মেমোরিটাকে রিক্রিয়েট করবে, রুপা? ইট মে হিল!”“আই ডোন্ট হ্যাভ এনি স্কার টু হিল!”“ইউ হ্যাভ ওয়ান। আ ভেরি ডিপ ওয়ান!”রুপা তাকাল নির্জনের দিকে। হাসল উদাসীন। সুক্ষ শুকনো হাসির রেশটুকু কাঁপিয়ে দিল ওর গালের বিষণ্ণ তিলিটাকে। বলল, “হাঁটবেন? সেদিনকার মতো অতো গভীরে যাব না আজ!”নির্জন রুপার হাতটা তুলে নিল হাতে। বলল, “ভাগ্যিস জুলফিকার সাহেব ইনভেস্টিগেশন ক্যান্সেল করেছে! না হলে এতক্ষণ ওদের পেছনে পেছনে ঘুরতে হতো!”“আসলেই! সব মাটি হয়ে যেত তাহলে!”, কিছুটা জোড়াল শোনাল রুপার কণ্ঠ, উৎফুল্লও।হাঁটতে লাগল ওরা রেললাইন দিয়ে। সহজ নয় কাজটা- নির্ভর করতে হচ্ছে পরষ্পরের উপর। বারবার লাইনচ্যুত হচ্ছে ওরা, পড়ে যাচ্ছে, হোচট খাচ্ছে, আবার উঠে আসছে লাইনে। শুরু করছে আবার হাঁটা।কিছুদূর গিয়ে থামল ওরা। ডান পাশের জঙ্গলে বানরের একটা দল হুটোপুটি করছিল। ওদের থেমে থাকতে দেখেই বুঝি, তীক্ষ্ণ শব্দে চিতকার করে চলে গেল জঙ্গলের ভেতরে।“এখন একটা ট্রেন এলে বেশ হয়, তাই না?”, বলল রুপা।রুপা ঘেমে গিয়েছে। জানলার কাচে ইলিশেগুঁড়ির দিন যেমন জল জমে, ঘাম ফোঁটা ফোঁটা জমেছে মুখে- ভ্রুর উপরে, নাকের ডগায়, ঠোঁটের রেখায়।“একটা শিশি আনলে ভালো করতাম বোধয়!”, বলল নির্জন, রেললাইনে বসে পড়ে।নির্মল হাসল রুপা। বলল, “তাই তো! সমস্যা নেই, আমি আরো ঘামব!”“জানেন এ জঙ্গলে মায়া হরিণও আছে? গতবার এই রেল লাইনেই সীমান্তের সাথে মায়া হরিণ দেখেছিলাম!”“জানতাম না!”, বলল নির্জন। “কিছুদিন আগে খবরের কাগজে সিএনজির ধাক্কায় হরিণ মারা যাওয়ার খবরে জেনেছি!”রুপা বসল নির্জনের মুখোমুখি, রেললাইনেই। ওর দিকে তাকিয়ে হাসি ধরে রেখে বলল, “সেদিন এতদূর পর্যন্ত শুধু হাঁটাই হয়েছিল নাকি…”মুখ ফিরিয়ে নিল রুপা। ওর মুখে স্পষ্ট হাসি দেখতে পেল নির্জন। বলল, “আপনি খুব বেশি জানতে চান!”পকেট থেকে সিগারেট বের করে জ্বালল ও। টান দিয়ে বলল, “এমন নিরালা স্বর্গীয় পরিবেশে কপোত কপোতীর স্পার্ক করতে সময় লাগে? তাই জিজ্ঞেস করছিলাম!”“আপনি না! আপনার মুখে কিচ্ছু আটকায় না! আমি সত্যিই জঙ্গলি!”, আনত মুখে হাসি অমলিন রেখে বল রুপা!বানরের দলটা ফিরে এসেছে আবার। ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে কানাঘুষো করছে বোধহয়, “ঐ দেখ, আমাদের আপডেটেড ভার্সন!”“সেদিন সীমান্ত খুব বাড়বাড়ি করছিল!”, আলতো স্বরে বলতে লাগল রুপা, চোখের দৃষ্টি নির্জনের দিকে না ফেলে। “ও সাধারণত এমন করত না!”“জঙ্গলে এলে সবার আদিম প্রবৃত্তিটা জেগে ওঠে বোধহয়!”, বলল নির্জন।“কিছুক্ষণ আদর করতে দিয়েছিলাম। তারপর বাঁধা দিয়েছি। রুমে তো যাচ্ছিই, এখানেই কেন?”নির্জনের সিগারেটটা শেষ হয়ে এসেছে প্রায়। ঠোঁটে আঁচ লাগছে আগুনের, হালকা একটা টান দিয়ে মোতাটাকে রেললাইনে পিষে দিল ও। সোজাসুজি তাকাল রুপার মুখের দিকে, বলল, পলক একবারও না ফেলে, “সেই মেমরিটাকে রিক্রিয়েট করব না আমরা?”চমকে ওর দিকে তাকাল রুপা। চোখাচোখি হলো পলকের জন্য- খুব রাবীন্দ্রিক ও যথেষ্ট ক্লিশে একটা বিশেষণ মনে পড়ল ওর- “কালো হরিণ চোখ!”চুপ করে রইল রুপা। এটাকে কি মৌনসম্মতি ধরে নেবে নির্জন?কী একটা পাখির কর্কশ চিতকারে চমক ভাঙল নির্জনের। রুপা চুপচাপ তাকিয়ে আছে নিচের দিকে, লাইনের পাথর গুনছে যেন।“সব মেমোরি কি রিক্রিয়েট যায়?”“চাইলেই যায়! সঠিক মানুষ পেলে!”ওর হাতে হাত রাখল নির্জন। ডান হাতটা তুলে চুমু দিল মধ্যমা আর তর্জনির উপর। চোখ তুলে তাকাল রুপা। নির্জন ওর ডন হাতটা চালান করল রুপার স্তনে। গুঙিয়ে উঠল রুপা, “ইসস…”মুখ লাগিয়ে দিল ঘামে ভেজা ঘাড়ে। ওর ত্বকের গন্ধ নিয়ে, আলতো করে চালিয়ে দিল ভেজা জিহ্বা। আবারও শিউড়ে উঠল রুপা, কেঁপে উঠল শরীর। অস্ফুটে বলল শুধু, “এখানে নয়!”দাঁড়িয়ে গেল নির্জন, হাত টেনে দাঁড় করাল রুপাকেও। বলল, “আমার সাথে এসো!”হাতটা ধরেই রইল রুপার। হাঁটতে লাগল জঙ্গলের দিকে। রেললাইনের ধারের ঝোপ পেরোতেই সামনে খাঁড়া চড়াই। গাছের শিকড় ধরে উপরে উঠতে লাগল নির্জন। গাছগুলো জমজ ভাইবোনের মতো সেঁটে আছে একেঅপরের দেহে। দ্রুত উপরে উঠতে লাগল সে, রুপার হাতটা ছাড়ল না।“একটু আস্তে উঠুন। পড়ে গেলে হাত পা ভেঙ্গে যাবে!”কিছুক্ষণের মধ্যেই পাহাড়ের মাথায় উঠে এলো ওরা। উপর আগাছা একদম নেই, বড় বড় ঝাঁকড়া গাছগুলোর ছায়ায় লতাগুল্ম আর ঝোপ জন্মাতে পারেনি। বেনামি বনস্পতির লাল নীল রঙিন পাতা পাহাড়ের লাল মাটির উপর কাঁচাহাতে আঁকিবুঁকি করেছে যেন।ফাঁকা জায়গা দেখে দাঁড়াল নির্জন। রুপার খুব কাছে এসে, ওর মোমগালে হাত দিয়ে বলল, “সেদিন ভুল করেছিলে তোমরা, রুপা! সেই ভুলটা আজ সংশোধন করে নাও!”“কী ভুল?”“সেদিনের প্রকৃতির আদিম সন্তানের মতো প্রকৃতির কোলে তোমাদের মিলিত হওয়া উচিত ছিল। এই সুযোগ সবাই পায় না!”ওর হুডির চেনটা একটানে খুলে দিল নির্জন। তারপর এক এক করে খুলতে লাগল রুপার দেহের সব আবরণ। হুডির নিচের শার্ট, গেঞ্জি আর ব্রা- একে একে পড়তে লাগল মাটিতে।ঊর্ধ্বাঙ্গ উলঙ্গ করে এক হাত পিছিয়ে গেল নির্জন। ভাস্কর অনেকদিনের সাধনার পর মুগ্ধনেত্রে যেভাবে তাকিয়ে থাকে নিজের সৃষ্টিকর্মের দিকে, সেভাবেই তাকিয়ে রইল সে। একদৃষ্টিতে।খোলা লম্বা চুলের গোছা দিয়ে রুপা ঢেকে রেখেছে দুই স্তন; এখনো লজ্জায় অভিভূত- এখনই সবটা দেখাতে চায় না যেন।নির্জন অপলক। রুপার গলা থেকে নেমে আসা নীল শিরা উপশিরা, কণ্ঠির কাছের দুই জোড়া তিল, উন্নত স্তনের বাদামী পুরু বৃন্ত, চর্বিহীন পেটের মাঝে অগভীর কুয়ো ছোট্ট নাভি!“অসাধারণ!”, বলল নির্জন। “আমি স্কাল্পচার হলে তোমার ভাস্কর্য তৈরি করতাম শ্বেতপাথরের!”“এভাবে তাকিয়ে থাকবেন না। লজ্জা লাগছে!”অধর কামড়ে ধরেছে রুপা। অনেকটা চড়াইয়ের কারণেই বোধহয়, হাঁপাচ্ছে এখনো। উঠছে নামছে ওর বুক- শ্বাস নেয়ার সাথে সাথে দুলে উঠছে উন্নত ভরাট স্তনদুটো। ঘাম জমতে শুরু করেছে ওর বুকে। চিকচিক করছে বুকের খাঁজ।

3 thoughts on “ইনভেস্টিগেটর”

  1. বদ্দা, স্কিনে হাতের আঙ্গুলের ছাপ পড়ে না। হাতের আঙ্গুলের ছাপ পড়ে একমাত্র ফ্লাট সারফেসে, যেমন কাঁচের গ্লাস, দরজার নব… এমনকি তেল চকচকে বার্নিশড কাঠ ছাড়া নরমাল কাঠেও ছাপ পড়ে না। এটাই একমাত্র দূর্বলতা পেলাম। এছাড়া দূর্দান্ত লেখা।

Leave a Reply