উত্তর দেওয়ার কিছু ছিল না। আমি ওপরে উঠে নিজের ঘরে ঢুকে বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরি। মনের মধ্যে আবার সেই পুরানো বিরহের কান্না বেজে ওঠে, দু চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে সেই দুঃখে। বালিসে মুখ গুঁজে ডুকরে কেঁদে উঠি আমি। আঙুল কামড়ে ধরি যাতে আমার কান্নার আওয়াজ বাড়ির কেউ শুনতে না পায়।
ছোটমা কিছু পরে আমার ঘরে ঢুকে আমাকে জিজ্ঞেস করে, “কিরে এই সময়ে শুয়ে আছিস কেন? সন্ধ্যে বেলায় শুয়ে থাকতে নেই উঠে পর।”
বুকের মাঝে চিৎকার করে উঠি আমি, “আমাকে কি একটুকু সময়ের জন্য একলা ছাড়া যায় না, ছোটমা।” না আমার সেই চিৎকার গলা থেকে বের হয় না, বুকের কান্না বুকের কোনে লুকিয়ে যায়। কোনোরকমে উঠে পরে বাথরুমে গিয়ে চোখ মুখ ধুয়ে আসি আমি।
রাতের বেলা খাওয়ার সময়ে ছোটমা জিজ্ঞেস করে আমি কি কিনতে চাই। আমার মন একদম ভালো ছিল না। কিসের জন্য আনন্দ, কিসের জন্য নতুন জামা কিনব আমি? কে আছে আমার কাছে যে আমার রুপ, আমার সৌন্দর্য দেখবে? না, সে ত আমার জীবন থেকে বিতাড়িত।
বাবু আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “পরী, কি হল এত চুপচাপ কেন?”
আমি মাথা নাড়িয়ে জবাব দেই যে, কিছু হয়নি আমার। কিন্তু সত্যি কি কিছুই হয়নি? সত্যি কি আমার হৃদয় উতফুল্ল ছিল সেই উত্তর দেওয়ার জন্য? কেউ কি বুঝতে পেরেছিল আমার বুকের ব্যাথা? কেউ কি শুনতে পেরেছিল আমার পাঁজর ভেঙ্গে শত টুকরো হয়ে ছড়িয়ে গেছে?
রাতের খাবার পরে বাথরুমে গিয়ে আবার খানিক কেঁদে নিলাম আমি। কান্না যেন আর থামেনা আমার চোখের জল যেন ফুরিয়ে ও ফুরাতে চায় না। গালের সেই গোলাপি লালিমা আর নেই, চোখের কোনে কালি। আয়নায় দেখতে চেষ্টা করলাম, মুখ খানি কেমন যেন ফ্যকাসে দেখায়। জন্ডিস হয়নি ত? না আমার জন্ডিস হয় নি, আমার জীবনের সব রঙ যে উবে গেছে। গালের লালিমা, চোখের কাজল, ঠোঁটের মিষ্টতা, সবকিছু শেষ।
রাতে শোবার আগে প্রতিদিনের মতন ছোটমায়ের সাবধান বানী, “দরজা বন্ধ করবি না।”
আমি আমার বিশাল বিছানায় একা শুয়ে থাকলাম। চোখে বন্ধ করে পরে থাকলেই কি আর ঘুম আসে, না, অনেক ক্ষণ এই পোড়া চোখে ঘুম আসে না। চলে যাবার আগেরদিন আমার বুকের মাঝে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল। সেই আগুন আজো আমাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। নরম বালিস বুকে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত পিষে কেঁদে ফেলি আমি। রাতের অন্ধকার আমার কান্না দেখে যেন হেসে ওঠে হি হি করে।
জানালার পাশের গাছের ডাল গুলি যেন নড়ে উঠে আমাকে ভুতের মতন কাছে ডাকে। চলে যাবার পর থেকে প্রতি রাতে আমার খোলে চোখের সামনে ভেসে উঠত ওর মুখ। আমি জেগে কাটিয়ে দিতাম রাত, ওর স্বপ্ন দেখে। ঘুম আসতো না তাও, একসময়ে আকাশের তারা গুনতাম, দশ হাজার এক, দশ হাজার দুই…
পরদিন আমি আর ছোটমা পুজোর বাজার করতে শ্যামবাজার গেছিলাম। ছোটমা আমার কেনা কাটার ব্যাপার আমার ওপরে ছেড়ে দিয়েছিলেন। ভঙ্গুর হৃদয়ের ওপরে পর্দা দিয়ে হাসি হাসি মুখ নিয়ে ছোটমায়ের পাসে দাঁড়িয়ে কেনাকাটা করি। দুটি সুন্দর সালোয়ার কেনা হল, একটা হলুদ আর লাল রঙের আর একটা তুঁতে রঙের। ছোটমা নিজের জন্য একটা দামী ঢাকাই জামদানি শাড়ি কিনলেন। ছোটমা আমাকেও শাড়ি কেনার জন্য বললেন কিন্তু আমার কোন শাড়ি পছন্দ হয়নি। শেষ পর্যন্ত ছোটমা আমার জন্য একটা চায়না সিল্কের কাথা স্টিচ শাড়ি কিনে দিলেন। শ্যামবাজারে জামা কাপড় কেনার পরে ছোটমা আমাকে নিয়ে বউবাজার গেলেন।
আদর করে আমাকে বললেন, “আমার পরীর বিয়ের জন্য কিছু গয়না কিনতে ত হবে।”
আমি মৃদু হেসে দিলাম।
আমার ঠোঁটে ম্লান হাসি দেখে ছোটমা আমাকে বললেন, “আমার লক্ষ্মী মেয়ে। এই হাসি যেন সর্বদা ঠোঁটে লেগে থাকে। তুই বড় হয়েছিস, সব কিছু বুঝতে শিখেছিস।”
আমি ছোটমাকে বললাম, “ছোটমা, আজ বাড়ি চল। আজ আর গয়না কিনতে হবে না।”
ছোটমা, “ঠিক আছে, আজ না হয় বাড়ি ফিরে গেলাম। এই নিয়ে কিন্তু দ্বিতীয় বার খালি হাতে ফিরছি। পরের বার কিন্তু গয়না কিনেই ফিরব।”
হ্যাঁ, এই নিয়ে দ্বিতীয় বার আমারা বউবাজার থেকে খালি হাতে ফিরছিলাম। আগে একবার আমার গয়না কেনার কথা হয়েছিল, সঙ্গে ছিল ও, সেদিন গয়না কেনার বদলে এস্প্লানেড গিয়ে আমার জিন্স আর টি শার্ট কেনা হয়েছিল। সেদিন ছিল খুশির দিন, মনের ভেতরে ছিল এক অধবুত আনন্দ।
কিছুদিন পরে আমি বাবুর কাছে সেলফোনের আব্দার করি। বাবু আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “সেলফোন কেন চাই?”
আমি, “কলেজের সবার কাছে সেলফোন আছে, শুধু আমার কাছে নেই তাই।”
আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বাবু উত্তর দিলেন, “তোমাকে সেলফোন দিলে সারা দিন ত বন্ধু বান্ধবীদের সাথে আড্ডা মারবে।”
আমি আদর করে বাবুর কাছে আব্দার করি, “বাবু, প্লিস প্লিস, আমি কথা দিচ্ছি আমি বেশিক্ষণ সেলফোনে গল্প করব না।”
বাবু হেসে উত্তর দিলেন, “ঠিক আছে। তোমার ছোটমা এলে আমি আর তুমি বাজারে যাবো খানে। দোকানে গিয়ে যেটাতে হাত রাখবে সেটা আমি কিনে দেব।” তারপরে আমাকে মৃদু বকুনি দিয়ে বলে, “মাসে কিন্তু চারশ টাকার রিচারজ হবে তার বেশি নয়।”
আমি আনন্দে নেচে উঠে বাবুর গলা জড়িয়ে ধরে বলি, “আমার সোনা বাবু। এক কাপ চা খাবে নাকি?”
আমার দিকে স্নেহ ভরা হাসি দিয়ে বললেন, “ঘুস দেওয়া হচ্ছে নাকি? তা সোনা মায়ের হাতের চা খেতে পারি, মন্দ নয়।”
বিকেলে ছোটমা স্কুল থেকে ফিরে আসার পরে বাবু ছোটমাকে জানালেন সেলফোনের কথা।
ছোটমা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “কেন চাই সেলফোন?”
বাবু, “উলুপি, পরী আর ছোটো বাচ্চা নয়, কলেজে এমএসসি পড়ছে। ছাব্বিশ বছর বয়স হয়ে গেল পরীর।”
ছোটমা বাবুকে বললেন, “হ্যাঁ, তুমি কি বুঝবে মায়ের ব্যাথা। যার মেয়ে সুন্দরী, শিক্ষিতা আর অবিবাহিতা সেই মায়ের রাতের ঘুম হয় না চিন্তায়।”
আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “রোজ দিন আমাকে কল লগ দেখাবি।”
ওই কথা শুনে আমি রেগে যাই আর চিৎকার করে উঠি, “আমি কি একটুকু স্বাধীনতা পর্যন্ত পাবো না?”
বাবু আমার দিকে কড়া নজরে তাকিয়ে বললেন, “পরী, তোমাকে অনেক স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল, মনে করে দেখ, সেই স্বাধীনতা পেয়ে তুমি কি করেছিলে।”
আমি ব্যাথিত হয়ে উঠে রেগে চিৎকার করে উঠি, “চাই না আমার সেলফোন।”
ছোটমা আর বাবুর মুখের সামনে দরজা বন্ধ করে বিছানায় লুটিয়ে পড়েছিলাম সেদিন।
মহালয়ার কিছু দিন আগে, আমি বসার ঘরে বসে টিভি দেখছিলাম, ঠিক সেই সময়ে বাবু কিছু কোর্টের কাগজ নিয়ে ঘরে ঢোকেন। আমি জিজ্ঞেস করাতে আমাকে জানালেন যে ওই কাগজ গুলি আমার লিগাল গারডিয়ানশিপের।
বাবু, “তোমার মা লিগাল গারডিয়ানশিপের কাগজে সই করে দিয়েছে।”
আমি বাবুর দিকে একবার চেয়ে দেখে, কাগজে সই করে দিয়েছিলাম। সেইদিন থেকে আমি কানুন মাফিক এক সম্রাট সম্রাজ্ঞীর বাঁধা রাজকন্যে হয়ে গেছিলাম।
বন্দিনী আমি এক রাজকুমারী। আমার দিনের আলো ম্লান আর রাতের অন্ধকার বেদনায় ভরা। সোনার খাচায় বন্দি আমি রাজার তোতা পাখি। নস্বর পৃথিবীর সব সুখ আমার পায়ের নিচে, ভালো জামা কাপড়, ভালো খাবার। ঠিক সেই সোনার খাচার তোতাপাখির মতন। সকাল সন্ধ্যে সম্রাট আর সম্রাজ্ঞী আমাকে শিশিরের জলে স্নান করায়, আঙ্গুর আর বাদাম খেতে দেয়, কিন্তু আমার পায়ে সেই সোনার বেড়ি।
বন্দিনী আমি এক রাজকন্যে!
***
আমার কলেজের প্রথম দিন। প্রেসিডেন্সি কলেজের বিশাল গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকতেই বুকটা কেমন যেন কেঁপে উঠল। বাবু আমাকে ছাড়তে গেট পর্যন্ত এসেছিলেন, তারপরে আমি বলেছিলাম যে আমি আর ছোটো মেয়ে নই, বাকি টুকু আমি একা যেতে পারব। করিডোরে ছাত্রদের জিজ্ঞেস করে এমএসসি ফিসিক্সের ক্লাসে ঢুকি। পরনে ছিল সাদা লম্বা স্কার্ট আর ঢিলে সাদা শার্ট। গলায় সবসময়ে একটা স্টোল জড়িয়ে রাখতাম। কাঁধের ওপরে আমার চুল ছোটো একটা হাত খোঁপা করে বাঁধা, ঠিক যেমন কলেজের দিনে সাজতাম সেই রকম আর খোঁপার মধ্যে গোঁজা আমার পেন।ক্লাসে ঢুকতেই লক্ষ্য করলাম যে কয়েক জোড়া চোখ আমাকে নিচ থেকে মাথা পর্যন্ত মেপে নিল। ছেলে গুলর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে ক্লাসে ঢুকে পরি আমি। ক্লাসে ঢুকতেই করিডোর থেকে কেউ আওয়াজ দেয়, “গুরু যা কাটপিস একদম মাস্টারপিস মাল।” কান দিলাম না ওদের কথায়। ক্লাসে বেশির ভাগ ছেলে আর কয়েক জন মেয়ে। সেকেন্ড বেঞ্চে একটা উজ্জ্বল শ্যম বর্ণের মেয়ে বসে ছিল আর অন্যদের সাথে বেশ চুটিয়ে গল্প করছিল। আমাকে ঢুকতে দেখে আমার দিকে তাকিয়ে হেসে কাছে ডাকে। আমি চুপ করে গিয়ে ওর পাসে বসে পরি।আমাকে মেয়েটা জিজ্ঞেস করে, “তুমি যেমন ভাবে ক্লাসে ঢুকলে তাতে সন্দেহ নেই যে তুমি কোলকাতার মেয়ে নও। তোমার বাড়ি কোথায়?”আমি উত্তর দিলাম, “দমদমে।”মেয়েটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, “জাঃ বাবা, তুমি দমদমে থাকো?”আমি হেসে উত্তর দেই, “হ্যাঁ বাবা, আমি দমদমে থাকি।”মেয়েটা, “আমি তিস্তা সরকার, লেকটাউনে থাকি আর তোমার নাম?”আমি, “শুচিস্মিতা মন্ডল।”তিস্তা, “ঠিক ধরেছিলাম, তোমার হাসিটার মতন তোমার নাম।”তিস্তার কথা শুনে লজ্জা পেয়ে গেছিলাম আমি, একি রে, একটা মেয়ে আমার হাসি দেখে পাগল। “ধ্যাত, মাথা খারাপ নাকি।”তিস্তা চোখ টিপে বলে, “ফার্স্ট পিরিওড বাঙ্ক করবে? চল কফি হাউস যাই।”আমি মাথা নাড়াই, “না না, ফার্স্ট পিরিওড বাঙ্ক করব না, কফি হাউস পরে যাওয়া যাবে।”আমাদের পেছনের বেঞ্চে বসা একটা মেয়ের দিকে দেখিয়ে বলল, “এর নাম ডেলিসা খাতুন, পার্ক সার্কাসে থাকে।”সত্যি বলছি, আমি একটা মুসলমান মেয়েকে এমএসসি ফিসিক্সে দেখব বলে আশা করিনি। খুব সুন্দরী আর ফর্সা ডেলিসা, গায়ের রঙ যেন আপেলের মতন লাল। গাড় নীল রঙের সালোয়ার পড়ে ছিল আর মাথায় জড়ানো কালো সুন্দর হিজাব।আমি ওকে জিজ্ঞেস করি, “মাথার কাপড় কি সবসময়ে পরে থাকতে হয়?”হাত নাড়িয়ে উত্তর দেয় ডেলিসা, “না রে, আব্বাজান বার বার বলে তাই পড়া। আম্মি ত হিজাব পরতেই দেয় না, বলে যে আমি অনেক বড় হয়ে গেছি ওই সব হিজাব পরে কি হবে যখন এমএসসি পড়তে যাচ্ছি।”ঠিক সেই সময়ে পেছন থেকে কেউ আমাদের উদ্দেশ্যে জোর গলায় টিটকিরি দেয়, “গুরু আজ ত কাঠের বেঞ্চে আগুন লেগে যাবে।”আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে চেষ্টা করি যে কে বলল কথা টা। তিস্তা ছেলেটার দিকে চেঁচিয়ে ওঠে, “গা… মুখ বন্ধ রাখ।” আমাকে বলল, “ওর দিকে তাকিও না।”আমি ওকে জিজ্ঞেস করি, “ছেলেটা কে?”তিস্তা, “দেবব্রত, আমার আগের কলেজের বন্ধু। বড় ফাজিল কিন্তু পড়াশুনায় খুব ভাল বিশেষ করে কোয়ান্টামে খুব ভাল।”আমি দেবব্রতর দিকে তাকালাম, বেশ লম্বা চওড়া ছেলে, চোখে চশমা, গায়ের রঙ একটু তামাটে। গোঁফ দাড়ি কামানো, পেছনের দিকে আঁচড়ান চুল, ছোটো চোখ। দু হাত পেছনের বেঞ্চে ছড়িয়ে দিয়ে বসে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে দেখেই কেমন যেন মনে হল, বুকের ছাতি বেশ চওড়া। সাদা নীল ডোরা কাঁটা জামার ভেতর থেকে যেন বুকের ছাতি বেড়িয়ে এসেছে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে হাত নারালাম। আমাকে দেখে দেবব্রত দুই আঙুল দিয়ে পিস্তলের ইশারা করে গুলি মেরে দিল।