তিস্তা আমাকে জিজ্ঞেস করল, “এই মিতা, এই পুজোতে কি কিনছো?”
আমি মাথা নাড়িয়ে উত্তর দেই, “কিছু না রে। দেখি ছোটমা আমাকে যা কিনে দেবে তাই পরব আর কি।”
“তুমি না একদম কি যে বলি।”
গালে আলতো চাঁটি মেরে হেসে উত্তর দিল তিস্তা।
নাক কুঁচকে হেসে জিজ্ঞেস করি, “তোর কি খবর? তুই কি কিনবি এই পুজোতে?”
কাছে এসে কানেকানে বলে, “দাড়াও, আমার নতুন বয়ফ্রেন্ড যদি আমাকে কিছু পড়তে দেয় তবে না আমি কিছু পরে থাকতে পারব।”
আমি ওর দিকে চোখ টিপে জিজ্ঞেস করি, “বাঃবা… দুষ্টু মেয়ে ত তুই, তা এই নতুন ছাগল টি কে?”
ও আমার দিকে চোখ টিপে উত্তর দিল, “কেন, তোমার দরকার নাকি? আমি চেখে দেখি তারপরে তোমাকে না হয় দিয়ে দেব।”
আমি ওর গালে আলতো চটি মেরে বলি, “জাঃ আমি কারুর এঁটো খাই না।”
তিস্তা আমার দিকে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, “কেন, তুমি নতুন কাউকে পাকড়াও করেছ নাকি?”
আমি মাথা নাড়িয়ে হেসে উত্তর দিলাম, “না রে বাবা, আমার সেই ক্ষমতা নেই কাউকে পাকড়াও করার। ছোটমা বাবু জানতে পারলে আমাকে আস্ত রাখবে না তাহলে।”
দিনটা ছিল, শুক্রবার, আমি দাঁড়িয়েছিলাম কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে, এই প্রেসিডেন্সি থেকে বেড়িয়ে চৌমাথায় দাঁড়িয়ে বাড়ি ফেরার জন্য বাসের অপেক্ষা করছিলাম। কোলে ধরেছিলাম পাটের ব্যাগ। দেরি দেখে বারবার হাতের ঘড়ির দিকে চোখ যাচ্ছিল। বাসের দেরি, ওদিকে বাবুর কঠিন আদেশ যে সন্ধ্যের আগে যেন বাড়ি ঢোকা হয়।
ছোটমা আমার নিজের মা নয়, আমার দূর সম্পর্কের দিদি হন, আমার মায়ের বয়সি। আমি দিদিকে ছোটমা ডাকতাম কেননা আমি যখন ছোটো ছিলাম তখন আমার বাবা মারা যান আর ছোটমা আমাকে তাঁর ভালোবাসা আর স্নেহ দিয়ে বড় করেছিলেন। রাতের পর রাত যখন আমার চোখে ঘুম আসতো না, ছোটমা আমাকে কোলে করে নিয়ে গান গেয়ে ঘুম পারাত আর আমি ছোটমায়ের গান শুনে তাঁর কোলে ঘুমিয়ে পড়তাম। আমি দাদাবাবু কে বাবু বলে ডাকতাম। বাবার স্নেহ বা আদর কি, সেটা আমি কোনদিন জানতে পারিনি, তাই আমি বাবুর ভালবাসায় পিতৃ স্নেহ খুঁজে এই খরা হৃদয়কে সিঞ্চন করতাম। আমার ছোটো দাদা, সুব্রতদার বিয়ের পরে ছোটমা আমাকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে আসে আর সেই জন্যেই আমি সেদিন কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে দাঁড়িয়ে বাসের অপেক্ষা করছিলাম।
আমি প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হই, সেপ্টেম্বর 2001 এ, বি এস সি রেসাল্টের পরেই। ছোটমা আর বাবু অনেক কে ধরে আমার এডমিসান করিয়ে দিয়েছিলেন কলেজে। আমার মেজর ছিল নিউক্লিয়ার ফিসিক্স।
গত পঁচিশ বছরের মধ্যে সেই দুর্গ পুজো আমার সব থেকে বেদনাময় কেটেছিল। বুকের পাঁজর ভেঙ্গে রক্তাক্ত হয়ে গেছিল সেইবার। সামনে পুজো, কোলকাতা সাজ সাজ রব, আকাশে বাতাসে কেমন যেন পুজো পুজো গন্ধ। লোকেরা সব নতুন জামা কাপর পরে কেনা কাঁটা করতে বেড়িয়েছে। বর্ষার শেষ আকাশ ঘন নীল, তাঁর মাঝে মাঝে তুলোর মতন পোজা পোজা মেঘের ভেলা ভেসে বেড়ায়। বুক ভরে শ্বাস নিলে যেন ধুপ ধুনোর গন্ধ পাওয়া যায় সেই আকাশে আর বাতাসে। কান পেতে শুনলে যেন আগমনির সুর ভেসে আসে। কিন্তু আমার কানে সেই সুর বাজে না।
আমি চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকি বাসের জন্য আর তিস্তা ওর সেলফোনে কারুর সাথে কথা বলতে থাকে। আমার সেলফোন ছিলনা। বাবু কিনে দেয়নি আমাকে। বেশ খানিক পরে বাস এসে গেলে আমি বাসে চেপে বাড়ির উদেস্যে রওনা দেই।
বাড়ির চাবি বাবুর কাছেও থাকে আর আমার কাছে একটা থাকে। ছোটমা দেরি করে বাড়ি ফেরে তাই ছোটমায়ের কাছে বাড়ির চাবি থাকেনা। আমি চাবি খুলে বাড়ি ঢুকে দেখি বাবু বাড়িতেই ছিলেন, নিজের ঘরে বসে পেপার পড়ছিলেন। আমার বাবু, গত মাসে এয়ারপরট অথরিটি অফ ইন্ডিয়া, দমদম এয়ারপোর্ট এ সিনিয়ার ম্যানেজার পদ থেকে অবসর পেয়েছেন। বাবু এমনিতে খুব কড়া ধরনের মানুষ তাই বাড়িতেও সেই রকম থাকতেন, সব কিছু যেন নিয়ম মাফিক চাই বাবুর।
আমি ঘরে ঢুকতেই বাবু আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “সোনা মা, কলেজ কেমন গেল?”
আমি নিচু স্বরে উত্তর দেই, “ভালো গেছে বাবু। হাওড়া থেকে যত বাস আসে সব কটাতেই কত ভিড় তাই বাস পাইনি আর একটু দেরি হয়ে গেছে।”
বাবু আমাকে বলল, “ঠিক আছে, সোনা মা এক কাপ চা হবে কি?”
আমি উত্তর দিলাম, “ঠিক আছে করে দিচ্ছি।”
কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে রোজকার প্রশ্ন বাবুর যে আমার কলেজ কেমন গেল। বাবুর মেজাজ ভালো থাকলে আমাকে সোনা মা বলে ডাকে আর না হলে পরী।
আমি যথারীতি জামাকাপড় বদলে রান্না ঘরে ঢুকে যাই চা বানানোর জন্য। তাক থেকে সসপেন নিয়ে উনুনে চাপিয়ে জল ঢেলে দিলাম। চোখের সামনে সসপেনে জল ফুটতে শুরু করে আর আমি আমার খেয়ালে ডুবে যাই। জলের বাস্প আমার চোখে মুখে লেগে আমার চোখে জল নিয়ে আসে। একটি ছোটো ভুলের মাশুল গুনছি আমরা দুজনে। বলেছিল আমাকে যে জীবন ঠিক ৬৪ খানা দাবার ছকের মতন, ৩২ টা কালো আর ৩২ টা সাদা। আমার হৃদয় আমার ভালোবাসা আমার কাছ থেকে চলে যাবার পর, আমি এক প্রাণহীন শ্বেত পাথরের মূর্তি হয়ে গেছিলাম। কি তার পাপ? সে আমাকে ভালবেসেছিল সেটাই তার পাপ? নিজের বাড়ি থেকে তাকে চলে যেতে হয়। কেন সে কি ভালবেসে ভুল করেছিল? আমাকে খুব ভালবাসত যে, আমার প্রাণহীন দেহে প্রান দিয়েছিল, ম্লান ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে তুলেছিল। আমাকে নিয়ে গেছিল সুদুর পাহাড় চুরায়, সেই ছোটবেলার ছেলে খেলার মতন আমাকে নিয়ে খেলত। শীতের রাতে যখন আমার শীত লাগত, আমি ওর বাহু পাসে বদ্ধ হয়ে নিজেকে ভুলে যেতাম, ওর বাহুপাস যেন আমার কাছে সব থেকে নির্বিঘ্ন স্থান ছিল, যেখানে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমাতে পারতাম। কিন্তু সে ত আর নেই আমার কাছে, চলে যেতে হয়েছে তাকে। আমি ওর চেয়ে দু বছরের বড় তাই আমাদের ভালোবাসা পাপ, না ও আমার ছোটমায়ের ছেলে বলে আমাদের ভালোবাসা পাপ। কে এই প্রশ্নের উত্তর দেবে, কাকে বুঝাই আমি ভালোবাসা পাপ নয়।
বুক চিরে, পায়ে ধরে ছোটমা কে বুঝাতে চেষ্টা করেছিল যে ভালোবাসা পাপ নয়, কিন্তু সেই কথা ছোটমায়ের কানে যায় নি। বুঝাতে চেষ্টা করেছিল যে বয়সের ব্যাবধান কিছুনা আর আমাদের মাঝে রক্তের কোন সম্পর্ক নেই যে আমাদের সম্পর্ক কোন পাপের পরিনত হতে পারে। কিন্তু ছোটমা সমাজের অজুহাত দেখিয়ে আমাদের সম্পর্ক মেনে নিলনা। ছোটমা আর বাবু ওর চলে যাওয়ার পর থেকে আমার ওপরে খুব কড়া নজর রাখত। তিনতলার সেই ঘরে চিরকালের জন্য তালা বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমাকে ছাদে যেতে দেওয়া হতনা। বাড়ির দেওয়াল থেকে, মেঝে থেকে, পর্দা থেকে জানালা থেকে, ওর চিনহ মুছে ফেলা হয়। ওর জামাকাপড় এক নয় গরিব মানুষকে না হয় বাসন অয়ালাকে দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। নতুন কেউ বাড়ি এলে বাড়ি দেখে জানার অবকাশ ছিল না যে ছোটমায়ের একটা ছেলে আছে। বাড়ি থেকে এমন ভাবে ওর চিনহ মুছে ফেলা হয়েছিল। নতুন লোকে সবাই জানত যে আমি ছোটমায়ের একমাত্র মেয়ে।
ওর দেওয়া সেই ঘিয়ে রঙের শাল খানি ছোটমা নিয়ে নেয় আমার কাছ থেকে। ওর চিহ্ণ স্বরুপ ওর ভালোবাসা আমার বুকে আঁকা আর থেকে যায় ওর সেই ধুসর রঙের ডায়রি, আমার বাইবেল, আমার কোরান আমার গীতা। কথায় বলে, প্রদীপের তলায় অন্ধকার তাই আমি সেই ডায়রি টাকে মলাট দিয়ে তার ওপরে “অপ্টিক্স নোটবুক” লিখে আমার পড়ার বইয়ের তাকে রেখে দিয়েছিলাম। সবার চোখ যেত কিন্তু নজরে আসতো না কারুর। অপ্টিক্স ওর সবথেকে প্রিয় সাব্জেক্ট ছিল।
ও চলে যাওয়ার পরে ওর ব্যাপারে বাড়িতে কেউ কথা পর্যন্ত বলত না। রাতে আমাকে দরজা খুলে শুতে হত। ছোটমা হয়ত ভয় পেত যে আমি দুঃখে হয়ত আত্মহত্যা করে ফেলি যদি। কিন্তু আমি ছিলাম গ্রামের এক সাদাসিধে মেয়ে, আত্মহত্যা করার মতন সাহস আমার বুকে ছিল না। আমি একটা পাথরের মূর্তির মতন জীবন বেছে নেই। নিজের মনে কাঁদতে পারতাম না, সবসময়ে যেন এক জোড়া চোখ আমাকে লক্ষ্য করে থাকত। শুধু মাত্র বাথরুমে গেলে আমি আমার মতন সময় পেতাম, একটু কেঁদে হালকা হয়ে নিতাম। কত বার চেষ্টা করেছিলাম আয়নায় মাথা পিটিয়ে আয়না ভাঙ্গার, কিন্তু হায় অদৃষ্ট, আয়নাও আমার সাথে ছিল না। আমি প্রানপন চাইতাম যে আয়না ভেঙ্গে যাক আর কাঁচের টুকরো মাথায় ঢুকে আমার যেন মাথা ফেটে যায়, কিন্তু না পোরা কপাল আমার, আয়না আমাকে দেখে হাসত।
বাবু আমাকে ডাক দেয়, “সোনা মা, চা কি হয়ে গেছে? আমাকে আবার বাজার যেতে হবে।”
আমি, “না বাবু এই এক মিনিটে হয়ে যাবে।”
আমার চোখের এক ফোঁটা জল হয়ত সেদিন ওই চায়ের জলে মিশে গেছিল। হাতের উলটো পিঠে চোখ মুখ মুছে চায়ের কাপ হাতে করে বাবুর ঘরে যাই। আমি চায়ের কাপ বাবুর সামনে রাখি, বাবু পেপার পড়তে মগ্ন।
আমার দিকে না তাকিয়েই বললেন, “কাল তোমার ছোটমা তোমাকে নিয়ে শ্যামবাজার যাবে পুজোর বাজার করতে। এবার পুজোয় কি কিনবে তুমি?”
আমি কিছু না উত্তর দিয়ে বাবুর সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি। বাবু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখেন যে আমার চোখের পাতা ভিজে। মুখ দেখে বাবু বুঝে গেলেন আমার বুকের মাঝের বেদনা। দাঁতে দাঁত পিষে উঠে চলে গেলেন।
গম্ভির স্বরে আমাকে বললেন, “তোমার ছোটমা আসার পরেই আমি বাজার যাবো, সেটাই ভালো।”
বাবু উঠে বসার ঘরে চলে গেলেন আর টিভি চালিয়ে বসে পড়লেন। যাবার আগে আমার দিকে পেপার দিয়ে বলে গেলেন যে, “তোমার কিছু যদি কাজ করার না থাকে তাহলে পেপার পড়ো, তাতে তোমার ইংরাজি ভালো হবে।”
ঠিক সেই সময়ে কলিং বেল বেজে ওঠে। নিচে নেমে দরজা খুলে দেখি ছোটমা এসে গেছেন। ছোটমা আমাকে দেখি হেসে আমার চিবুকে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করেন, “কিরে, তোর কলেজ কেমন গেল?”
আমি মৃদু হেসে মাথা নেড়ে জানালাম যে কলেজ ঠিক ঠাক গেছে।
সিঁড়ি দিয়ে চড়ার সময়ে ছোটমা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, “তোর বাবু কি করছে রে?”
আমি উত্তর দিলাম, “বাবু বসার ঘরে বসে টিভি দেখছে।”
ছোটমা একটু বিরক্ত হয়ে বললেন, “বুড়ো টার আর কোন কাজ নেই। আমি বাজারে যেতে বলেছিলাম, ঘরে কোন সবজি পাতি নেই, ফ্রিজ খালি। আর এখনো বসে টিভি দেখছে?”