পর্ব ১৯
“কারা যেন কথা বলছে, তাই না?”, স্বাতি ভিত গলায়, ফিস ফিসিয়ে জিজ্ঞেস করল। তবে রতন কিন্তু তখন পাথরের মতো স্থির হয়ে গেছে। আর স্বতির সেই প্রশ্ন শুনে সে নিজের ঠোঁটে আঙুল দিয়ে সকলকে চুপ করতে বলে মাটিতে বসে পড়ল। তার দেখাদেখি বাকিরাও সেই ভাবে বসে পড়ল। কিন্তু সেই আওয়াজ থামলো না। মনে হল যেন দূরে কারা কথা বলছে। কিন্তু তারা কি যে বলছে, কিছুই বোঝার উপায় নেই।
“ম্যাডাম, ওরা কিন্তু জলদশ্যু হতে পারে। আমাদের খুব সাবধান থাকতে হবে। আমরা এখানে আছি জানলে আমাদের আক্রমনও করতে পারে”, রতন বলে উঠল।
“ওরে বাবা, আমার খুব ভয় করছে। এখান থেকে চলো…”
“ভয় পাসনি, স্বাতি, আমরা আছি তো…” তুলসী তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে উঠল। “আলসো অন আ পসিটিভ নোট, এটা একটা অ্যাডভেঞ্চারও হতে পারে, তাই না…”, মুখে এ কথা বললেও ভেতরে ভেতরে তুলসীরও একটা চাপা অশান্তি হচ্ছিল।
“সুস! সুস! একটুও আওয়াজ নয়” রতন আবার ফিসফিস করে বলে উঠল, “তোমরা বরং এখানে দাঁড়াও, আমি একটু এগিয়ে গিয়ে দেখি ব্যাপারটা কি হচ্ছে…”
ওদিকে আমাদের তুলসীও পিছিয়ে থাকার পাত্রি নয়, তাই সেও বলল,”হমমম চলও সারেঙ, আমিও যাচ্ছি তোমার সাথে…”
রতন আর তুলসী, সারেঙ আর তার ম্যাডাম, হামাগড়ি দিয়ে ওপরে উঠল। তারা যে সেখানে আছে সেটা না জানলে তাদের দেখতে পাওয়া খুবই শক্ত। ওপারেই বড় সমুদ্র আর তার কোলে ছোট্ট মন্দির। মন্দিরের পেছনে একটা বেশ উঁচু পাথরের টিলা । হতে পারে টিলার পাথর কেটেই মন্দির তৈরি করা হয়েছে । মন্দির আর সমুদ্রের মাঝে চওড়া বালির বিচ। সেই বিচে একটা ইনফ্লেটেবল নৌকো রাখা আছে। আর দুটো লোক সেই নৌকো থেকে নেমে সেই দিকে হেঁটে যাচ্ছে একটা বড় বাক্স নিয়ে। রতন আর তুলসী, বিচে না নেমে, গাছের ঝোপের ভেতর দিয়ে মন্দিরটার কাছে এগিয়ে গেল। লোকদুটো তাদের অবশ্য দেখতে পেল না। ভারি মাল টানতে ওদের বেগ পেতে হচ্ছিল। ওরা একটু পরে এসে পৌঁছোলে, ওদের কথোপকথন শোনা গেল।
“এখানে যাদের থাকার কথা ছিল তাদের কাউকে দেখছি না যে”
“অপেক্ষা করব? নাকি জাহাজে ফিরে যাবো? এখানে একবার জোয়ার নেবে গেলে সেই ভোরের আগে আবার ফেরা যাবে না কিন্তু”
“হ্যাঁ জানাব, আর দিনের আলাতে ফেরাও তো মুস্কিল। আমাদের দেখলেই কোস্ট গার্ড ধরে ফেলবে…”
“হমম, তবে তুই এক কাজ কর, চাটগাঁয়ে একবার জিজ্ঞেস করে নে…”
আর ওরা তাই করল। “হাঙ্গর কলিং বাজপাখি। হাঙ্গর কলিং বাজপাখি। ওভার।” দুই আগন্তুক রেডিওতে কল করতে শুরু করল। বেশ কয়েকক্ষন সেই ভাবে কল করার পর ওপাশ থেকে উত্তর এল।
“বাজপাখি কলিং হাঙ্গর। শুনতে পাচ্ছি। ওভার।”
রেডিওতে এবার ওদের কথোপকথন শুরু হল। মোদ্দা কথা বোঝা গেল যে এরা এখানে ওরা দু-একদিন থাকবে। এদের লোকাল কনট্যাক্টের আসার একদিন দেরী হয়ে গেছে। ওরা এসে পৌঁছলেই মাল হ্যান্ডওভার করে চলে যাবে। যে জাহাজে ওরা এসেছে, সেটা মাঝ সমুদ্রে অপেক্ষা করবে। ইতিউতি মাছ ধরার ভান করবে।
সব ব্যাপার বুঝে রতন আর তুলসী চুপিচুপি পেছু হেঁটে ফিরে এল যেখানে বাকি দু-জন অপেক্ষা করছিল। তারপর ওরা সবাই মিলে নিজেদের জাহাজে ফিরে এল।
“এত পরিস্কার বোঝাই যাচ্ছে যে এরা টেররিস্টদের আর্মস এন্ড এমুনিশান সাপ্লাই করছে…”
“হমম, আর তাই জন্যই আমাদের এখান থেকে মানে মানে পালিয়ে যাওয়াই ভাল ম্যাডাম। নিজের দায়িত্বে আমি আপানাদের এখানে এনেছি, আপনাদের কোন ক্ষতি হলে সেটাও তো আমার দায়িত্ব হবে”, রতন বলে উঠল।
“না সারেঙ, তুমি আমাদের নিয়ে ভয় পেয়োনা। আমরা সবাই এডাল্ট। আমাদের ভাল আমরা বুঝি আর দরকার পড়লে, দরকার পড়লে নিজের দেশের জন্যে আমরা লড়ে যেতে পারি”,গলায় একটা দৃঢ়তা নিয়ে বলে উঠল তুলসী।
“কিন্তু আমরা ঠিক কি করতে পারি, মাসি? আমাদের কাছে না আছে কোন আর্মস না আছে কোন অ্যামিউনিসান্স…”
“তবে শোন”, বলে তুলসী একটা ছক তৈরি করতে লাগল।
পর্ব ২০
তখন গভীর রাত। কৃষ্ণপক্ষের কালো আকাশে শুধু অগনিত তারা চকচক করছে আর তারই নীচে আন্ধকারের মধ্যে, সেই দুই অজানা, অচেনা আগন্তুক তাদের ইনফ্লেটেবল ডিঙি নৌক থেকে তিন চারটে বাক্স টেনে নিয়ে সেই পরিত্যক্ত মন্দিরের ভেতরে তুলে রাখছে।
এরপর ওদের কাজ শেষ হয়ে গেলে ওরা বিচের এক পাশে বসে ধূমপান করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল।
“এবার কি একটু শুয়ে নেবে কর্তা? ও শালারা তো আমাদের ভালো মতই ঝুলিয়ে দিল… “
“হ্যাঁ তা আমরা কি করব? সব কিছু কি আর প্লান মেনে চলে”
“সেটা ঠিকই কিন্তু এখানে থাকতে হবে জানলে, আরও ব্যবস্থা করে আসতে পারতাম…মানে…”, ওদের মদ্ধে একজন বলে উঠল।
সেই শুনে দ্বিতীয় বেক্তিটি মুখ ঝামটা দিয়ে বলল, “তুই কি শালা এখানে ফাইভ-স্টার হোটেলে ছুটি কাটাতে এসেছিস? এটা একটা অপারেসান, তাই আর মেলা কথা না বলে সঙ্গে আনা গুড় ছোলা জল খেয়ে মুতে শুয়ে পড়…”
“না মানে আমি সে ভাবে বলিনি কর্তা। মানে ফাইভ স্টার না হলেও, একটু লাল জল তো আনতে পারতে”
“হ্যাঁ বাঁড়া, ওইটাই বাকি আছে। মদ, বিরিয়ানি আর মাগী…”
“হ্যাঁ নিশ্চয়ই, আর সেটা চাইতে দোষটা কোথায়? জেনারেল আলোম তো সেদিন নিজেই বলছিলেন যে নিজের শরীর আর মন চাঙ্গা রাখার জন্য উনি নিয়মিত মাগীপাড়া যান…”
“আর ওই লোকটার একটা কথাও বিশ্বাস করিস না। ও শালা হেব্বি হারামি, দিনকে রাত বলে চালিয়ে দেওয়ার মত লোক। তবে… তোর মাথায় হঠাৎ মাগীপাড়ার কথা আসছে কেন? তোর কি মনে হয় এই নির্জন দ্বীপে কোথাও মাগীপাড়া থাকতে পারে”
“কর্তা, সেই রকম কিছু না থাকলেও অন্তত দুটো মাগী থাকলে তো আমদের হয়েই যেত, তাই না?”, এই বলে লোকটা এবার আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “হে উপারওয়ালা, আজ রাতে প্লিজ দুটো এন্টারটেনমেনট পাঠাও। প্লিজ আমাদের সময় কাটাতে হেল্প কর…”
আর মনের সেই আশা ব্যক্ত করতে না করতেই এক অসাধারণ চমৎকার ঘটনা ঘটে গেল। সেই পরিত্যক্ত মন্দিরের সংলগ্ন জঙ্গলের ভেতর থেকে ভেসে এল মহিলাদের হাসির ক্ষীণ খিল খিল কলোরব।
“এই! ওটা কার হাঁসি শুনতে পাচ্ছি?”, ওদের মধ্যে একজন বলে উঠল।
“কি…কি বলছিস মারা? এখানে আবার কে হাঁসতে যাবে?”
“তু…তুমি শুনতে পেলে না কর্তা?”
“কৈ নাতো?”
আর প্রায় সাথে সাথে আবার ভেসে এল হাঁসির আওয়াজ ভেসে এল। ক্ষীন কিন্তু পরিষ্কার। যেন মদের পাত্রে চামচে ঠুকে কেউ মদতরঙ্গ বাজাচ্ছে।
ওইদিকে দুই আগন্তুকের তখন সে কি উত্তেজনা। লোকাল কন্টাক্টের মাথায় মারো ঝাড়ু । উপারওয়ালা যখন নিজেই এইরকম কিছু পাঠিয়ে দিয়েছেন তখন তাদের আর পায় কে। সমুদ্রতটের বালুকাবেলা ছেড়ে তারা তখন পাগলের মতন সেই আওয়াজ উপলক্ষ করে ধাবমান হয়েছে। কিন্তু কোথায় সেই নারীমূর্তিগুলি? শুধুই তারা শুনতে পাচ্ছে সেই মনোমহিনী গানের অনুরনণ …
“এই সুন্দর স্বর্ণালী সন্ধ্যায়, একি বন্ধনে জড়ালে গো বন্ধু..
কোন রক্তিম পলাশের স্বপ্ন, মোর অন্তরে ছড়ালে গো বন্ধু”
গান তো ভালোই শোনা যাচ্ছিল কিন্তু সেই গানের গায়িকার দেখা পাওয়া বড়ই মুস্কিল। সেই মূর্তিগুলি গাছের আড়ালে আড়ালে পরীদের মত দৌড়ে বেড়াচ্ছে আর গায়ে টর্চের আলো পড়তেই তারা পালিয়ে যাচ্ছে। শুধুই কানে ভেসে আসছে সেই অসাধারণ প্রেম নিবেদনের বাণীঃ
“আমলকি পিয়ালের কুঞ্জে
কিছু মৌমাছি এখনো যে গুঞ্জে।
বুঝি সেই সুরে আমারে ভরালে গো বন্ধু”
এবার আর থাকতে না পেরে ওরা চিৎকার করে সেই গায়িকাদের থামতে বলল, কিন্তু তাদের কথা শুনতে তারা নারাজ। পাগলের মতো ঘুটঘুট্টে অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে তারা তখনও দৌড়চ্ছে। কখন পাবে সেই দুই সুন্দরীদেরকে নিজের হাতের মুঠোয় নাকি পায়ের মাঝে। ওরা দৌড়তে দৌড়তে বারাবার বলে চলল,”ভয় নেই, দাঁড়াও দাঁড়াও আমরা আসছি”। কিন্তু কে কার কথা শোনে?
“বাতাসের কথা সে তো কথা নয়, রূপকথা ঝরে তার বাঁশিতে,
আমাদেরও মুখে কোন কথা নেই, শুধু দু’টি আঁখি ভরে রাখে হাসিতে”
গান তো শোনা যায়, কিন্তু দেখা পাওয়া শক্ত। ‘মাঝে মাঝে তব দেখা পাই, চিরদিন কেন পাই না?’ হাতে ধরা টর্চের আলোর রশ্মি অনুশরণ করে দুই আগন্তুক ছুটে চলেছে অন্ধকারের বুক চিরে। এক নারীর হাতের আলো অন্যের গায়ে পড়েছে আর তাইতেই দেখা যায় তাদের অপরুপ সৌন্দর্যের ছটা। কিন্তু কই? কখন পাবে তাদের। উঁচু নিচু খানা খন্দ ঘেরা পথ। গর্তে, কাদায় পা আটকে যাচ্ছে। কিন্তু তাও ছুটে চলেছে ওরা দুজন। আলেয়ার হাতছানি উপেক্ষার করার শক্তি কি আর তাদের আছে?
“কিছু পরে দূরে তারা জ্বলবে
হয়তো তখন তুমি বলবে
জানি মালা কেন গলে পরালে গো বন্ধু…”
“একি?”, দৌড়তে দৌড়তে ওরা দুজনেই হঠাৎ একই সঙ্গে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল, তারপর নিজেদের পায়ের কাছে সেই সুন্দরীদের ছেড়ে ফেলা শাড়ি ব্লাউস, সালওয়ার কামিজ পড়ে থাকতে দেখে একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়াই করতে লাগল। “এ…এর মানে কি কর্তা”, ওদের মধ্যে একজন হঠাৎ বলে উঠল।
“এর মানে, তারা এবার আমদের কাছে ধরা দেবার জন্য তৈরী হয়েছে”, বলে সামনের দিকে তাকাতেই সেই বেক্তি আবার বলল,”ওই তো। ওরা থেমে গেছে আর দৌড়চ্ছে না…”