মধুর মাহেন্দ্রক্ষণ

তারিখটা আজও মনে আছে। ২৩ মার্চ, ২০১৯।

একটা ইঞ্জিনিয়ারিং ভার্সিটিতে পড়ি। ফোর্থ ইয়ারের বিজোড় সেমিস্টারের ৪ সপ্তাহ ক্লাস হয়েছে মাত্র। এখন রোজার ছুটি। বাসায় এসে দুদিন শান্তিমতো থাকতে না থাকতে বিয়ের নিমন্ত্রণ এসে গেল। আমার এক মাসতুতো বোনের বিয়ে। লাভ ম্যারেজ। প্রায় সমবয়সী, বন্ধুর মতো ছিল বোনটা। কবে এতো বড় হয়ে গেল বুঝি নি। সাতদিন পরে বিয়ে। কিন্তু যেতে হবে কালই। বললাম, “সবেমাত্র বাসায় এসে নিঃশ্বাস ফেললাম, এখন হবে না।” সাথে সাথে ঝাঁঝিয়ে উঠল,”আসতে হবে, ঘরে বসে নিঃশ্বাস ই ফেল তুই। ঘরকুনো কোথাকার।” বলেই কুট কুট করে কেটে দিল ফোনটা। দিন দিন বড় হচ্ছে আর দজ্জাল হচ্ছে। জ্বালিয়ে খেল। কথাটা অবশ্য মিথ্যে বলে নি। পাকা ঘরকুনো হয়েছি৷ বাসায় আসলে এখন পাশের বাড়ির বন্ধুরাও মাঝে মাঝে টের পায় না। আর এই আমি একসময় দুপুর রোদে ফুটবল খেলে কালো হয়েছি। অবশ্য লোকে শ্যামলা বলে আমাকে।

কি আর করা? মা কে বললাম। মা মাথায় হাত বুলিয়ে, সোনা বাবা বলে রাজি করাল। কান্ড দেখলে হাসিও পায় মা’র। এখনো ছোট্টো বাচ্চার মতো মনে করে। বললাম না বোনকে। একবারে গিয়ে সারপ্রাইজ দেব। 

গিফ্ট হিসেবে একটা বেশ দামী শাড়ি নিলাম। লাল রঙের, মাঝে সোনালী ডিজাইন। লাল রঙে মেয়েদের বেশি মানায়। দুপুরে গিয়ে হাজির হলাম। মাসতুতো ভাইটা ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। বিশাল বিচ্ছু। আমাকে দেখেই দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলতে শুরু করল,”তিন বছর পর এলে রুদ্র দা! আগে কতো ঘনঘন আসতে। দিদি তো তোমার পাকা নাম দিয়ে দিয়েছে, ঘরকুনো।” বললাম,”শাঁকচুন্নিটা কই রে?” “ঘরে নাক ফুলিয়ে আছে। গিয়ে দেখো।”

গিয়ে দেখি ম্যাডাম ঘর গোছাচ্ছে। বললাম,”বাব্বাহ্, বিয়ে না হতেই একদম পাকা একদম পাকা গিন্নি হয়ে গেছিস দেখি তিন্নি।” মুখ ঝামটে বলে উঠল,”তিন বছরে একদিন খোঁজ নিয়েছ এসে, কেমন পরিবর্তন হয়েছে তোমার বোনের। আসতে হবে না তোমার। যাও, ঘরে বসে নিঃশ্বাস ফেলো গে।” বুঝলাম, খুব খেঁপে আছে। ঠান্ডা করার একটাই উপায়, কথা ঘোরাতে হবে। গিয়ে সামনে দাঁড় করিয়ে গালে হাত দিয়ে বললাম,”আসলেই অনেক পরিবর্তন হয়েছে রে। কবে এতো বড় হলি বল তো? রাহুল দা তো ঠিক বুঝে তুলে নিয়ে যাচ্ছে।” হেসে ফেলল। রাহুল দা, ওর প্রেমিক আর হবু বর। পাঁচ বছরের প্রেম ওদের। ওর থেকে দু বছরের বড়। বোনটার মুখের হাসিটা দেখে বোঝা যাচ্ছে, কতটা খুশি ও। কিন্তু মুখে বলল,”ঐ বেয়াদবের কথা আর বোলো না। আস্ত বেয়াদব একটা। সারাক্ষণ বিয়ে বিয়ে করে মাথা খারাপ করে দিল। এতো করে বললাম, পড়াটা শেষ করে নি। হবে না। সে নাকি পড়াবে বিয়ের পর। হঠাৎ একদিন দেখি ওর বাবা মাকে নিয়ে হাজির আমাদের বাসায়। ব্যাস। হয়ে গেল আমার পড়া।” হো হো করে হেসে দিলাম,”রাহুল দার তাহলে আর তড় সইছে না, তাই না?” সাথে সাথে কিল ঘুষি খেলাম কিছু ওর হাতে।

যাই হোক, মারধর খেয়ে, হাসি ঠাট্টায় আরেকদিন গেল। এরপর এলো সেই দিন, ২৩ মার্চ। সকালে উঠতে দেরী হল রাতের আড্ডার জন্য। এলোমেলো চুলে বাইরে এসে ৪৪০ ভোল্টের ঝটকা খেলাম নাকি ঝকঝকে দুপুরে বজ্রপাত হল মাথায়, বলতে পারব না। একটা নীল পরী আমার বোনের সাথে কথা বলছে। মাঝে মাঝে হাসছে, আর কিসব যেন বলছে। আবার হাসছে। নীলপরী বললাম কারণ একটা সুন্দর কাতানের নীল শাড়ি পড়ে ছিল। এতো লাবণ্য, এতো মায়া ভরা নিষ্পাপ মুখ সাতজন্মে দেখি নি হলফ করে বলতে পারি। হুশজ্ঞান হাড়িয়ে হা করে তাকিয়ে রইলাম। উচ্ছলতায় ভরা সেই মুখে কি অমোঘ আকর্ষণ, বলে বোঝাতে পারব না। কোনো কামনা ছিল না। শুধু দেখছিলাম, আর ভাবছিলাম,”এতোটা সুন্দর কিভাবে হয়?” 

হঠাৎ মুখ ফিরিয়ে তাকাল আমার দিকে। চোখাচোখি হওয়ায় হকচকিয়ে চোখ সরিয়ে অন্যদিকে তাকানোর ভান করলাম। কিন্তু নিশ্চিত ধরা পড়ে গেছি। ইশশশ, কি লজ্জা! কখনো কোনো মেয়ের দিকে ৩/৪ সেকেন্ডের বেশি তাকাই নি। সেই আমি কিনা এতোক্ষণ, তা প্রায় এক মিনিট তো হবেই, হা করে…। ইশ। অন্য কেউ দেখে নি তো?

দেখেছে, এবং সবথেকে ডেঞ্জারাস ব্যাক্তিই দেখেছে। শাঁকচুন্নিটা। একটু পরে আমার সামনে এসে দাঁড়ালো। পাশ কাটিয়েও যেতে দিল না। তারপর গলা খাঁকারি দিল। মনে দশ নম্বর বিপদ সংকেত বেজে উঠল। গেছে রে। দেখে ফেললো নাকি? তাহলে এই পাঁচ ছয়দিন একটানা খেপাবে। বললাম, “কি হল? যেতে দে।”

– যেতে দে, তাই না? সকালে কতগুলো মাছি পেটে ঢুকেছে, টের পেয়েছিস? হা করে তাকিয়েই ছিলি যে, আশপাশের হুশজ্ঞান তো কিছুই ছিল না দেখলাম।

– ইশ, তুইও দেখেছিস? 

– আমি দেখেই তো ওকে বললাম। তারপরই তো ও তোর দিকে তাকালো।

– ধ্যাৎ, কাজটা একদম ঠিক করিস নি। কি ভাবল বল?

– তুমি এমনভাবে হাআআআ করে তাকিয়ে থাকবে, আর কেউ কিছু ভাবলে দোষ? 

– ইশশ, দেখ, বিশ্বাস করিস বা না করিস। এতো সুন্দরী কাউকে সাত জন্মে দেখি নি এতোটুকু বলতে পারি। তাই খেয়াল ছিল না কতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম। তুই তো জানিস আমি কেমন? কিন্তু আজ যে কি হল, বুঝলাম না। এখন খুব খারাপ লাগছে। বিশ্বাস কর, আমি শুধু মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম, অন্য কোনোরকম আবেগ আমার ছিল না তিন্নি। কিন্তু কি জানি, কিসব ভাবছে? নিশ্চয়ই খুব খারাপ ভাবছে আমাকে, বল? 

– বাব্বাহ্, আমার ব্রহ্মচারী ভাউয়ের এক মুহূর্তে মাথা ঘুরিয়ে দিল আমার বান্ধবী! গাধা কোথাকার, কি ভাববে হ্যা? কেউ মুগ্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকলে মেয়েরা খুশিই হয়, বুঝলি? আর তোর চেহারা কি কোনো বখাটের মতো যে খারাপ ভাবে নেবে? তুই তখন এমন হকচকিয়ে হন্তদন্ত হয়ে পালালি, তা দেখে হেসে  আমাকে জিজ্ঞেস করল,”কে উনি?”

একমুহূর্তে আমার চারিধারে যেন বসন্ত নেমে এলো। তেমন কিছু তো না, শুধু আমি ওর কি হই, এটুকু জানতে চেয়েছে। কিন্তু আমার মন শত নুপুরের ধ্বনিতে নেচে উঠল এই ভেবে যে, সে হেসেছে এবং আমার ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড। খুশিটা কোনোক্রমে চেপে রেখে বললাম,

– আচ্ছা, তো তুই কি বললি?

– বললাম, আমার মাসতুতো দাদা। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে। প্রায় সমবয়সী এবং নিখাঁদ ব্রহ্মচারী।

যদিও শেষ কথাটা একটু ভুল। ভালো লেগেছিল একটা মেয়েকে, বিইসিএম ডেপ্টের। কিন্তু আমি প্রপোস করার আগেই দেখি অন্য একজনের সাথে হাত ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পড়ে শুনলাম, মেয়েটার অনেকের সাথেই রিলেশন ছিল।এসব বাদ দিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলাম,

– ব্যাস, আর কিছু বলিস নি?

– আর কি বলব? 

– যে আমি কত ভালো মনের মানুষ, কত নিষ্পাপ একটা ছেলে!

– আহাহাহা, শখ কত! শোন, মেয়েদের ক বললে কলকাতা বুঝে নেয়। আর কাউকে দেখেও সাথে সাথে কিছু ধারণা নিয়ে ফেলতে পারে। এসব তুই বুঝবি না।

– আচ্ছা, ওনার বয়ফ্রেন্ড নেই? 

– নাহ্।

– এতো সুন্দরী, অথচ বয়ফ্রেন্ড নেই! আজব!

– ছিল একজন, কয়েক মাসের প্রেম। পরে সেই ছেলে সিগারেট ধরল, আর এ ছেড়ে দিল। এখন সে ছেলে বিশাল গুন্ডা। ভাগ্যিস বেশিদিন আগায় নি।৷ নাহলে ওর যে কি হত!

শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। এতো সুন্দরী প্রেমিকা থাকতে অন্য কিছুর নেশায়ও ধরতে পারে! যাই হোক, আমার কপাল সুপ্রসন্ন। 

– নাম কি?

– বলব না, পারলে নিজেই জেনে নিস। হুহ। কতকি বলে দিলাম। এখন ট্রিট দে। 

দিলাম ট্রিট। দামী দামী অনেকগুলো চকলেট, আইসক্রিম, আর ওর পছন্দের রেস্টুরেন্টের চিকেন কাবাব খাওয়ালাম। ওতো দেখে মহাখুশি। কিন্তু খোঁটা দিতে ছাড়ল না। বলল, 

– তুই তো দেখি পাগল দিওয়ানা হয়ে গেছিস রে। বুঝেছি, বুঝেছি তোর মতলব। আচ্ছা, আরো সাহায্য করব। কিন্তু খবরদার, হাবলামি করবি না একদম। শুধু আড়চোখে দেখিস। আর তোর স্বাভাবিক কাজকর্ম করিস। ঘরে বসে না থেকে বিয়ের কাজকর্ম করিস। দেখে খুশি হবে। তারপর ওর মনে কি চলছে আমি বুঝে নেব।

খুশিতে জড়িয়ে ধরলাম। বললাম, “বোনরে, তুই এত্তো কিউট ক্যানো! আশীর্বাদ করি, একশ সন্তানের মা হ।” বলেই দৌড় দিলাম। পিছন থেকে শুনতে পেলাম, “হারামজাদা, ফাজিল কোথাকার। দাঁড়া, তোর কি করি দেখ।”

যাই করুক না কেন, সাহায্য ও করবেই এটা জানি।

ব্যাস, কাজ শুরু করে দিলাম। এ কাজে ও কাজে হাত লাগাচ্ছি, আর নানা অজুহাতে ওর আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছি, কাজের বাহানায়। বুঝছে হয়তো। বোঝে বুঝুক, আমার কি? পছন্দ করেছি, কোনো পাপ তো করি নি।

এভাবে তিনদিন গেল, চতুর্থ দিন বোনকে ডাকতে ওর রুমে যাচ্ছি, পথে ওনার সাথে দেখা। আমি হাতজোড় করে নমস্কার দিলাম। সেও মিষ্টি হেসে প্রতিনমস্কার দিলো। ইশশ, এই হাসির সাথে প্রথম দিনের হাসির মিল আছে, তার মানে সেই কথা মনে রেখেছে আর মজা পাচ্ছে আমাকে দেখে। লজ্জায় দ্রুত তাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলাম। পিছন থেকে তার হাসির শব্দ ভেসে এলো।

প্রচুর কাজ করছি। সবাই বলাবলি করছে, ছেলেটা বেশ কাজের। বোনের বিয়ে যেন একাই সামলাচ্ছে। মনে মনে ভাবলাম, “সে কি আর সাধে? কি কারণে করছি, তা তো আর আপনারা জানেন না।” কিন্তু আসল কাজও হচ্ছে মনপ হয়, আমাকে সামনে দেখছে প্রায়ই, আর আড়চোখে তাকালে দেখছি, আমাকে খেয়াল করছে। ওদিকে বোনের পরামর্শ তো আছেই। দুদিক মিলে ভালোই কাজ হচ্ছে মনে হয়। 

গায়ে হলুদের দিন চলে এলো। একটা হলুদ শাড়ি পড়েছিল সেদিন। মাঝে মাঝে চোখ সরানো দায় হয়েছে। খোলা চুলে, কপালে ছোট্টো একটা টিপে কি অসাধারণ লাগছিল। কোনো মেকাপের বালাই নেই। আর মেকাপ করতে পছন্দ ও করে না, বোন বলেছে। একদম মনের মতো। বোনকে হলুদ মাখাতে গেলাম। কানে কানে বলল,” কথা বলেছিস?” “না।” “কবে বলবি? আর তো মাত্র দুদিন আছে।” বুকের মধ্যে ধক করে উঠল।আসলেই তো, সময় আর বেশি নেই। এসব ভাবছি, তখব আবার বলল, “লুকোচুরি না করে সাহসী ভাবে গিয়ে বল। দেখ কি হয়। কিন্তু তোর তো রসকস নেই, পারলে একটু রোমান্টিক ভাবে বলিস।”

– তোর বিয়ের থেকে কয়েকটা গোলাপ মেরে দিলাম তাহলে।

– হি হি, নিস। কিন্তু ওর বেশি পছন্দ হাসনাহেনা আর বেলী। দেখ জোগাড় করতে পারিস কিনা। 

কাছে ফুলের দোকান আছে। গোলাপ বোনের থেকে নেই নি আর, গোলাপ আর বেলী দোকানেই পাওয়া গেল। কিন্তু হাসনাহেনা, আর পাই না৷ ওখানে কিছু বন্ধু ছিল। ওদের কাছে গিয়ে বললাম কোথায় পাওয়া যাবে। শেষে অনেক ভেবে একজন বলল, গ্রামের অন্যপ্রান্তে এক ব্রাহ্মণ বাড়ি আছে। সেখানে থাকতে পারে। গেলাম চারজন মিলে। কিন্তু উঁচু পাচিল দেওয়া। দেখাও যাচ্ছে না। এক বন্ধু আছে বেঁটে, কিন্তু স্বাস্থ্যশরীর ভালোই। মানে এককথায় মোটা। ওর পিঠে দাঁড়ালাম। দেখা গেল ফুলগাছ, দেওয়াল ঘেঁষেই। ফিসফিস করে বললাম, লাঠি দে। একজন দৌড়ে গিয়ে লাঠি আনল। আমার ওজনও কম নয়। ৫’ ১০”। জিম করে বডিসডি হয়েছে বেশ। তাই নিচের মোটাটার অবস্থা একরকম নাজেহাল। দ্রুত লাঠি দিয়ে ডাল টেনে ৪ টা ফুল নিয়েছি, তখন ব্রাহ্মণ মহাশয় স্নান করে ফিরছেন। আমাদের দেখেই হৈ হৈ করে ছুটে এলেন। আমি ঘাড়ের উপর থেকে লাফ দিয়েই সবাই মিলে দৌড়। কিন্তু মোটাটা পিছনে পড়ে গেল। একটু দূরে গিয়ে দেখি ও ধরা পড়েছে। দাঁড়িয়ে গেলাম। ফিরে গেলাম ওর কাছে। বললাম,”সব দোষ আমার, আমাকে যে শাস্তি দিতে হয় দিন।” বলল,”তুমি কোন বাড়ির ছেলে?”

বললাম, “অমরনাথ বিশ্বাস আমার জামাইবাবু।” এটা শুনে একটু শান্ত হলেন। বললেন, “তা এখন ফুল চুড়ি করছিলে কেন?” বললাম, “আঙ্কেল, ওনার মেয়ের বিয়েতে লাগবে।” 

– বিয়েতে আবার হাসনাহেনা লাগে জানতাম না তো। 

সাজানোর অজুহাত দিয়ে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে, শেষে বিয়েতে নিমন্ত্রণ করে তারপর ছাড়া পেলাম।

এরপর ওদের ট্রিট দিলাম। তখন ভর দুপুর। তাড়া খেয়ে ঘেমে নেয়ে একাকার। ফিরে শুনি সবাই গঙ্গাবোড়াতে গেছে। এটা একধরনের অনুষ্ঠান, নদীতে গিয়ে তেল সিঁদুর দিয়ে আসে অনেক মেয়ে বউরা মিলে। ভাবলাম এই সুযোগ। যদি একটু ফাঁকা পাওয়া যায়, তাহলেই প্রপোজ করে দেব। কিন্তু বিধি বাম। একদম সবার মাঝে মাঝে সখীদের সাথে হাঁটছে। মন খারাপ করে ফিরে এলাম।

চুপচাপ বসে আছি। বোন এসে বলল,

– কিছু হল?

– নাহ্, ফাঁকাই পাচ্ছি না। 

– আহারে বেচারা!

– মজা করিস না তো, ভালো লাগছে না।

– আচ্ছা, আচ্ছা, মজা করছি না। আমার বিয়ে, আর আমার ভাই মন খারাপ করে বসে থাকবে, তাই হয়? যা, আমার বিয়ে উপলক্ষে তোকে আমার এই বান্ধবীকে দিলাম। ৯০% কাজ আমি করে দেব। তুই শুধু একটু ভালোভাবে প্রপোজটা করে দিস ভাই আমার। নয়তো আমার নাক কাটা যাবে।

– দিলাম মানে কি? ও কি কোনো জিনিস নাকি যে দেওয়া যাবে? মেয়েরা হলো দেবীর রূপ। বোন আমার, তুই শুধু একটু সাহায্য কর। 

– তোর এই জিনিস টা আমার সবথেকে ভালো লাগে, মেয়েদের সম্মান দিতে জানিস। আচ্ছা, আমি রাত ঠিক নয়টায় তোর কাছে পাঠাবো। পাশের মন্দিরের সামনে অপেক্ষা করবি। মনে থাকবে? 

– রাতের বেলায় আসতে ভয় পাবে না তো?

– তোর ভরসায় পাঠাবো। সমস্যা হলে সামলাতে পারবি না?

– জীবন যতক্ষণ আছে ততক্ষণ তো পারব।

– বাব্বাহ্, রোমিও একেবারে। দেখা যাবে, কতটা ভালো রাখিস আমার বোনকে সারাজীবন। 

– দেখিস তুই। কিন্তু আমার ভীষণ টেনশন হচ্ছে রে। 

– টেনশন নিস না। তুই ওর যোগ্য ছেলে। তোদের মিল হলে ভালো ছাড়া খারাপ হবে না এটা নিশ্চিত। একটু ধৈর্য্য ধরে চেষ্টা কর। ভালো মেয়েদের জীবনসঙ্গী পাওয়া এতো সহজ নয়, বুঝেছ বৎস?

– বুঝেছি বৎসী। এখন যান, আপনার বিয়ে, সবাই হয়তো খুঁজছে আপনাকে।

যাচ্ছি, বলে উঠে দাঁড়িয়ে পিছনে ফিরেই থ মেরে দাঁড়িয়ে গেল। দু সেকেন্ড পরে বলল,”নন্দিনী! তুই কখন এলি?”

বুকের মধ্যে ছ্যাৎ করে উঠল। পিছনে ফিরে দেখি স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বলল,”একটু আগে। তোকে খুঁজতে তোর রুমে গেছিলাম। না পেয়ে এখানে এলাম।”

আমার জানি না কি হল? হঠাৎ বললাম, তিন্নি, তুই যা। ওনার সাথে আমার কথা আছে। তিন্নি নিশ্চুপে চলে গেল।

আমি ফুকগুলো হাতে নিয়ে সামনে দাঁড়ালাম। যতই সাহসী দেখানোর চেষ্টা করি না কেন, কপাল ঘামে ভিজে গেছে। হাঁটু গেড়ে কোনোমতে কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,

– আপনি অনিন্দ্য সুন্দরী, এটা হয়তো অনেকেই আপনাকে বলেছে। কিন্তু আপনি আমাকে যতটা পাগল করেছেন, কেউ সাতজন্মেও করে নি। কাউকে দেখার জন্য এতটা উতলা কক্ষণো হইনি। সেই মানুষটা আপনি, যাকে পরবর্তী সাতজন্ম দেখলেও মন ভরবে না। এই কয়েকদিনে কয়েক হাজার বার আপনাকে দেখেছি আড়ালে থেকে, আর দেখার ইচ্ছে প্রতিবার শুধু বেড়েছে। আজীবন আপনার দায়িত্ব নিতে চাই, বিনিময়ে শুধু আপনাকে মন ভরে দেখতে চাই। সেই সুযোগটুকু দেবেন দয়া করে? 

আর একটা কথা, আমি আমার কথা বলে দিয়েছি। তবুও যদি শুনতে চান, স্পষ্ট ভাবে বলছি, আমি আপনাকে ভালোবাসি। আর বেসে যাবো, আপনি না বাসলেও। তবে যদি ভালোবাসেন, সবথেকে সুখি মানুষ হয়ে বুকে আগলে রাখব।

– ইঞ্জিনিয়াররা এতো আনরোমান্টিক হয়!!!

এই কথা শুনে আমার মাথায় হাত। গেল রে, সব গেল। জীবনে আর আমার দ্বারা প্রেম হল না রে।

যন্ত্রকৌশল পড়ে পড়ে যন্ত্র ই হয়ে গেলাম নাকি কে জানে। আবার কাঁপা কাঁপা গলায় বললাম,

– আসলে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ পড়েছি তো।

ঠোঁট চেপে মুচকি হাসল। আবার পাগক হওয়া অবস্থা। হা করে দেখছি। বলল,

– হয়নি, তিন্নি রাতে যেখানে বলল, সেখানে গিয়ে আবার করবেন। আর এই ফুলগুলো তখনও নিয়ে আসবেন।

– আমি আসব আপনাকে নিতে?

– এতো চিন্তা আমাকে নিয়ে! আচ্ছা আসবেন। এখন যাই, সবাই খোঁজাখুজি করছে হয়তো।

বলে একটা অভাবনীয় কাজ করল। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হয়তো ইচ্ছে করেই ওড়নাটা মুখের উপর দিয়ে বুলিয়ে নিয়ে গেল….

আর আমি আস্তে করে ঘাসের উপর পড়ে গেলাম।

টেনশনে দুপুরে খাওয়াও হল না। বোন এসে জিজ্ঞেস করেছিল, কি হল? বললাম, ও মুচকি হাসল, কারণ জিজ্ঞেস করলে বলল না। শুধু বলল, যাস রাতে মন্দিরে। 

রাতে আটটার দিকে মা দূর্গার ঐ মন্দিরে গিয়ে মনপ্রাণ দিয়ে প্রার্থনা করলাম। তারপর নয়টার আগেই ওর আশেপাশে ঘুরঘুর করতে শুরু করলম। দশটা বেজে গেল। এখনই খেতে দেবে। সে আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। শেষ মুহুর্তে গেট থেকে বের হল। চললাম পিছু পিছু। দুই তিন মিনিটের পথ মন্দির পর্যন্ত। সামনে দাঁড়িয়ে বলল, “যা বলার তাড়াতাড়ি বলো।”

তুমি করে বলায় একটু ভরসা পেলাম। আবার হাটু গেঁড়ে বসে বলতে গেলাম। বলল,

– কি করছ? মায়ের মন্দিরের সামনে এভাবে অন্য কারোর সামনে হাটু গেঁড়ে বসা ঠিক নয়। 

– মেয়েরাও তো মা দুর্গার আরেক রূপ।

– সে হোক, তুমি দাঁড়িয়েই বলো।

মনে যা আসে, তাই দিয়ে সুন্দর ভাবে গুছিয়ে রোমান্টিক ভাবে সব বললাম। সাথে একটা ছোটো স্বরচিত কবিতাও বলে দিলাম(যদিও ততটা ভালো হয় নি)।

– নাহ্, এবারও হল না। আরো সুন্দর ভাবে করতে হবে। কাল রাতে এই সময় আবার করবে। এখন খেতে চলো।

কষ্ট লাগল খুব। এমন ছলনা কেন করছে। রাজি না হলে বলে দিক। তাও করছে না, আবার হ্যা ও বলছে না। 

যাই হোক, পিছু পিছু গেট পর্যন্ত এলাম। এরপর ভিড়ের মধ্যে থেকে রুমে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। খিদে পাচ্ছিল না। দুপুরে খাই নি, তাও।

একটু পরে রুমে মা এলো খেতে ডাকতে। খাবো না, খাবো না করছিলাম, তখন তিন্নি এলো রুমে। এসে বললো, “মাসিমা, আপনি যান, আমি দেখছি।” মা ওর উপর দায়িত্ব দিয়ে চলে গেল।শুয়ে ছিলাম। তিন্নি মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

– “না” করে দিয়েছে?

– না, কিন্তু হ্যা ও বলে নি।

– তো খাচ্ছিস না কেন?

– আরে জানি না, টেনশন না কি কারণে খিদে পাচ্ছে না একদম। 

– এটা কিন্তু একরকম ব্ল্যাকমেইল করছিস ওর উপর। 

– ও কি জানে আমি খাই নি?

– খেতে বসার আগে তোকে খুঁজছিল। 

– তুই ওকে বলিস না প্লিজ। আমি তোকে কথা দিচ্ছি, খিদে লাগলেই আমি খেয়ে নেব। 

– তোর আসলেই খিদে নেই?

– আরে না। কি করব বল?

– আচ্ছা, কথা দিয়েছিস কিন্তু। মনে থাকে যেন।

– আচ্ছা বোন।

চলে গেল ও। খাওয়া হল না। মা গ্যাসের সমস্যা ভেবে একটা গ্যাসের ট্যাবলেট খাইয়ে দিয়ে গেল।

আজ বিয়ে। সকালে দেখছি খুব সুন্দর করে সেজেছে নন্দিনী। কিন্তু মুখ গোমড়া। আর রাগি চোখে আমার দিকে তাকাচ্ছে মাঝে মাঝে। পরে জেনেছি, বোন যখন আমার সাথে কথা বলছিল, ও তখন রুমের বাইরে দাড়িয়ে সব শুনেছে। 

দুপুরে ডেকোরেশন এর কাজ করছি। এমন সময় হঠাৎ কোথা থেকে এসে হাত ধরে টেনে নিয়ে চলল। ভাগ্যিস সবাই কাজ ব্যাস্ত তাই খেয়াল করে নি। সোজা নিয়ে মন্দিরের মাঠে। আমি একটা টু শব্দ ও করি নি। শুধু ওর চুল থেকে আসা মাতাল করা সুগন্ধ আর চুড়ির টুংটাং শব্দ শুনেছি পুরোটা পথ। এনে সামনে দাঁড় করিয়ে,

– সমস্যা কি তোমার? 

– সমস্যা? 

– গাধা নাকি তুমি? কোনো ছেলেকে পছন্দ না হলে কোনো মেয়ে সরাসরি না বলে চলে যায়, তার দিকে ফিরেও তাকায় না। আমি তোমাকে বারবার সুযোগ দিচ্ছি কেন? উত্তর দাও।

– কেন?

– ভগবান, এ কোন গাধা দিলে আমাকে। উফ। না দিয়েছ বুদ্ধি, না দিয়েছ ফ্লার্টিং স্কিল। ভগবান কেন যে ভালো ছেলেগুলোকে একটু ফ্লার্টিং করার ক্ষমতা দেয় না? সব বাজে ছেলেগুলোকে দেয়, আর তারা ভালো মেয়েগুলোকে পটিয়ে সর্বনাশ করে। আমার ভাগ্য ভালো, এ ফাঁদে পড়ার আগেই বের হতে পেরেছি। বাদ দাও। তোমাকে তো অক্ষরে অক্ষরে বুঝিয়ে দিতে হবে। গাধা কোথাকার। ভালোবাসি তোমায়। কানে কথা গিয়েছে? হ্যা, ভালোবাসি আমিও। এতো সহজ একটা মেয়েকে রাজি করানো? তাই বারবার ঘুরাচ্ছি। তোমার ঐ সরলতা, মেয়েদের প্রতি সম্মান আর লাজুক ভাবটার প্রেমে পড়েছি। ভেবেছি আজ রাতে ভালোভাবে প্রপোজ এক্সেপ্ট করবো। তার উপায় আছে? চব্বিশ ঘন্টার উপোষ রেখেছেন উনি। টেনশন না ছাই। গাধাটা রিলেশনের শুরুতেই জ্বালানো শুরু করল। সারাজীবন যে কত জ্বালাবে ঈশ্বর জানে। এখন তোমার যেটা করতে ইচ্ছে করছে করো। 

Leave a Comment