রাজিয়া বেগমের শোবার ঘর উঠানের পূর্ব পাশে হওয়াতে ঘরের পেছনের কাঠের দেওয়ালে ভোরের প্রথম আলো এসে পড়ে। ওপাশের বন্ধ জানালার ফাক দিয়ে এক ফালি আলো এসে ঘুম ভাঙিয়ে দেয় মর্জিনার। সূর্যটা যত উপরে উঠতে থাকে তত দুরে সরে যেতে থাকে আলোর রেখাটা। মর্জিনার চোখ থেকে সরে যায় নিচের দিকে। শ্যামলা বর্নের নগ্ন শরিরে ঢেউ খেলে একেবেকে নেমে যায় বিছানা থেকে মেঝেতে। তারপর এক সময় মিলিয়ে যায়।
নারী দেহের স্পর্শ না পেলে সূর্যদেবেরও ঘুম ভাঙে না, মনে মনে ভাবে মর্জিনা। অজান্তেই ডান হাত উঠে আসে বুকের কাছে, ফুলে উঠা স্তনের উপরে। শেষ বিন্দু টুকু মিলিয়ে যাওয়া পর্যন্ত তাকিয়ে থাকে আলোর রেখাটার দিকে। তারপর উঠে বসে। বিছানার পাশে খুলে রাখ কাপড় জড়িয়ে নেয় গায়ে।
সারা রাত জেগে কাটালেও সকালের এই সময়টাতে মর্জিনার ঘুম ভেঙে যায় আপনা আপনি। সারা বাড়ির কাজ তাকে একা সামলাতে হবে। বেলা করে ঘুমান চলবে না। বিছানা থেকে নেমে ফিরে তাকায় বিছানায় পড়ে থাকা ঘুমন্ত শরির দুইটার দিকে। কি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে ওরা। এভাবে একটা সকাল আলসেমি করে কাটিয়ে দেয়া গেলে বেশ হত।
আহা! হতাশার দীর্ঘ্যশ্বাস ফেলে ঘর ছেড়ে বের হয়ে যায় মর্জিনা কূয়াতলার দিকে।
মের্দা বাড়ি আর আগের মত নাই। বদলে গিয়েছে সময়ের সাথে। তিন বছর অনেক সময়।
রাজিয়া বেগমের মৃত্যুর পর মের্দাবাড়ির অন্দরমহলের ভার নেওয়ার মত আর কেউ ছিল না, অন্তত খলিল মের্দার এমনটাই মনে হয়েছে। মর্জিনা বাড়ির কাজের লোক, তার হাতে এত বড় বাড়ি সামলানোর ভার দেওয়া যায় না। মেয়ে রেবেকার বয়স কম, তা না হলে রেবকাই সব সামলাতে পারত এবং এই বয়সে আরেকটা বিয়ে করারও ইচ্ছা নাই খলিলের। সুতরাং অনেক চিন্তা ভাবনা করে সুমিতা সাবিত্রীর হাতে মের্দা বাড়ির দেখাশুনার ভার তুলে দেওয়া হবে মনস্থির করেন খলিল মের্দা।
মালিকের অনুরোধ ফেলতে পারেনি মাধব ধর আর সুমিতা। স্বপরিবারে র্মেদা বাড়ির ভেতরে চলে এসেছে। তাদের থাকার জন্য নতুন ঘর তোলা হয়েছে, খলিল মের্দার ঘরের পাশে।
কিন্তু লাভটা কার হল বুঝতে পারছেনা কেউ।
খলিল মের্দা ভেবেছে এখন সুমিতা সাবিত্রিকে কাছে পাওয়া আরো সহজ হবে, নিশ্চিন্তে সুমিতাকে চোদা যাবে যখন ইচ্ছা। মের্দাবাড়ির ভেতরের খবর কাক-পক্ষিও জানবে না। একই সাথে মের্দাবাড়ির দেখাশোনার চিন্তাও দুর হল।।
সুমিতা সাবিত্রী ভাবছে, মের্দা বাড়ির দখল এখন তার হাতে চলে এসেছে। ধিরে ধিরে খলিল মের্দাকেও সম্পূর্নরূপে হাতের মুঠোয় নিতে হবে। তারপর এমন ব্যবস্থা করতে হবে যেন তার দুই সন্তান মের্দা বাড়ির উত্তরাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পায়। (মের্দা বাড়ির ইতিকথা ০৩ # ইতিহাস দ্রষ্টব্য)
আর মাধব ধর ভাবছে তার বউকে দিয়ে মের্দাবাড়ির সম্পদে ভাগ বসাবে এবং ধিরে ধিরে মের্দাবাড়ির দখল নিবে সময় মত।
এই তিন জনেই মনে করছে নিজের লাভ হচ্ছে। কিন্তু সময়ে দেখা যাবে কে লাভবান হল শেষপর্যন্ত।
মাধব ধরের বাচ্চা দুটাকে রেবেকা আর রাজিবের সাথে রাখা হয়েছে। একসাথে পড়তে যাওয়া-পড়তে বসা, খেলাধূলা, খাওয়া-ঘুম সব কিছুই হচ্ছে আগের মত। র্কমচারির ছেলে-মেয়ে বলে তাদের সাথে ভিন্ন আচরন করা হচ্ছে না। সুমিতা সাবিত্রী নিজে খলিল মের্দাকে বলে এই ব্যবস্থা করেছে যাতে তার ছেলে-মেয়ে শিক্ষিত হতে পারে। কিন্তু সুমিতা রাজিব আর রেবেকার মধ্যকার সম্পর্কের কথা জানে না। খলিল মের্দা জানে। তাই খলিল মের্দা প্রথমে রাজিব-রেবেকার সাথে সুমিতার ছেলে-মেয়েকে রাখতে চায়নি। পরে সুমিতার জোরাজুরিতে খলিল মের্দা মেনে নিয়েছে, যা হয় হবে।
অন্দরমহলের ভার কাধে নিয়েই সুমিতা মের্দা বাড়িতে পরির্বতনের হাওয়া আনে। সেই সময়ে সারা উপমহাদেশ আধুনিক হওয়ার জোয়ারে ভাসছিল। বিলেত ফেরত শিক্ষিত মানুষের সংখ্যা বাড়ছিল দিনকে দিন। সেই সাথে জীবনযাত্রার মান বাড়ছিল পাল্লা দিয়ে।। বাড়ি-ঘরের নক্যশা-আকার-আকৃতি, ভেতরের আসবাবপত্র, নিয়ম-রিতি বদলে যাচ্ছিল। হুট করে সবাই কিছুটা সভ্য হওয়ার জন্য নিজস্ব সংস্কৃতির জলাঞ্জলি দিচ্ছিল নির্দ্বিধায়। সুমিতাও সেই দলে নাম লিখল।
প্রথমেই সে মের্দা বাড়ির সংস্কারে হাত দিল। বাড়ির সামনের ঘরটা ভেঙ্গে সেখানে বিশাল এক তলা ইটের বাড়ি উঠল। পোড়া মাটির বড় বড় ইটের মোটা দেয়াল তোলা হল বাড়ির চারধারে সিমানা দেওয়ার জন্য। ভেতরের ঘরটা ভেঙ্গে দোতলা বাড়ি তোলা হল। দামি আসবাবপত্র দিয়ে সাজিয়ে ভেতরের প্রথম ঘরটাকে খাওয়ার ঘর করা হল। উঠানের পশ্চিম পাশে খলিল র্মেদার শোবার ঘরটাও ভেঙ্গে সখানে নতুন দোতলা ঘর তোলা হল। রান্নাঘর, কূয়াতলা, চাকরদের ঘর সবখানেই পরির্বতনের চিহ্ন স্পষ্ট। শুধু র্পূব পাশে রাজিয়া বেগমের ঘরটা যেমন ছিল তেমন রয়ে গেল। খলিল মের্দা চাচ্ছিল না মায়ের ঘরটা ভাঙ্গা হোক।
রাজিয়া বেগমের ঘরটা মের্দাবাড়ির ইতিহাসের সাক্ষি হয়ে রয়ে গেল আগের মতন।
রাজিয়া বেগমের মৃত্যুর পরে মের্দা বাড়ি স্থবির হয়ে পড়েছিল। গ্রামের প্রায় সব মানুষ এসে জড় হয়েছিল র্মেদা বাড়িতে, বিশাল জায়গা নিয়ে জানাজা হয়েছিল মসজিদের সামনে, জানাজার পর সবার খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়ছিল বাইরের উঠানে- সব কিছু মিলিয়ে এলাহি কারবার। আশেপাশের অন্যান্য জমিদার বাড়ি থেকে গরিব-দুখিদের অর্থ সাহায্য করা হয়েছে রাজিয়া বেগমের রাহুর মাগফেরাত কামনা করার জন্য।
সেই দলে চৌধুরী বাড়ির নামও ছিল।
চৌধরী বাড়ির ছেলে বিশ্বজিত চৌধুরী নিজে র্মেদা বাড়িতে এসে খলিলের সাথে দেখা করে তার মায়ের মৃত্যুতে দুঃখ্য প্রকাশ করে গিয়েছে। বয়সে সে খলিল র্মেদার চেয়ে একটু ছোট হবে। চৌধুরী বাড়ির কারবার সব এখন সে দেখছে। তবে সে থাকে কলকাতায়। মাঝে মধ্যে গ্রামে আসে।
আরো আগেই ব্যবসার সিলসিলায় খলিল মের্দার সাথে বিশ্বজিত চৌধুরীর পরিচয় হয়েছে। কিন্তু খাতির ছিল না, হবে এমন আশা করাও বৃথা।
অনীল মের্দার মৃত্যুর পরে এই দুই পরিবারে মধ্যে এখন আর দা-কুমড়া সর্ম্পক নাই বটে, কিন্তু এর মধ্যে উল্লেখ করার মত কোন বন্ধুত্বপূর্ন সম্পর্ক তৈরি হয়নি। চৌধুরানী নীলারেনু চৌধুরী খলিল র্মেদার জন্মের সময় র্মেদা বাড়িতে এসে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সবার প্রথমে (মের্দা বাড়ির ইতিকথা ০২ # বিপ্রতীপ স্রোত দ্রষ্টব্য)। কিন্তু এ বাড়ি থেকে এখন পর্যন্ত কেউ চৌধুরী বাড়ি যায়নি।
খলিল র্মেদা এধরনের একটা উদ্যোগ নেওয়া কথা ভাবছিল কিছু দিন যাবত। বৃটিশদের সাথে টক্কর দিতে হলে নিজেদের ভেতরের লড়াই থামাতে হবে আগে।
একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠল রেবেকা। প্রথমে বুঝতে একটু সময় লাগল সে কোথায়। বিছানার মাথার কাছে কাঠের নকশাটা দেখে মনে পড়ল সব। রাজিয়া বেগমের মৃত্যুর পরে এ ঘরটা বন্ধ পড়ে ছিল বেশ কিছু দিন। পরে যখন সুমিতা বাড়ির সংস্কারে হাত দেয় তখন শোবার ঘরের ভাগ-বটোয়ারা নিয়ে মর্জিনার সাথে সুমিতার কথা কাটাকাটি হয়। সেদিনেই মর্জিনা রাজিয়া বেগমের ঘরে চলে আসে থাকার জন্য। সবাই ভেবেছিল এর জন্য খলিল মের্দা মর্জিনার উপর রাগ হবে। কিন্তু খলিল মের্দা খবরটা শুনে নির্বিকার ছিল।
এর পর থেকে রাজিয়া বেগমের ঘর এখন মর্জিনা ঘর।
এই তিন বছরে রেবেকা আগের চেয়ে আরো সুন্দর হয়েছে। শরিরের আকর্ষনীয় অঙ্গগুলি একটু একটু করে ফুটে উঠছে। কন্ঠে মাদকতার ছোয়া এসেছে। চোখ দিয়েই ছেলেদের পুরুষত্ব গিলে খাওয়ার কৌশল রপ্ত করে নিয়েছে। গায়ে এখনও বাচ্চা মেয়েদের মত কচি গন্ধ আছে কিন্তু এখন আর তাকে বাচ্চাদের দলে ফেলা যাবে না। মের্দা বাড়ির সুযোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে বড় হচ্ছে রেবেকা।
বুক পর্যন্ত চাদর টেনে আরেকটু আরাম করে শুয়ে পড়ল বিছানায়। এখনি উঠতে ইচ্ছা করছে না তার। অনেকদিন পর গত রাতে সে আর তার ভাই ছোটম্মার সাথে শুয়েছিল। সুখের আমেজটা আরো কিছুক্ষন ধরে রাখতে চাইছে রেবেকা।
দাদির মৃত্যুর দিনটা মনে পড়ে গেল তার। বাড়ি ভর্তি লোকজন বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত, দাদির লাশ, জানাজা, কবর দেওয়া- অথচ সে তার বাবার ঘরে বিছানায় পড়ে আছে। টানা দুই দিন সে ওঘরে ছিল, বিছানা থেকে উঠতে পারেনি। শরিরের গাটে গাটে ব্যথা ছড়িয়ে ছিল, একটু পর পর বমি আসছিল, ভোদার চারপাশের চামরা নীল হয়ে ফুলে ছিল আর দুপায়ে হাটার মত শক্তি ছিল না তার। মনে হচ্ছিল কোমড়ের নিচের অংশটুকু অসার হয়ে আছে (মের্দা বাড়ির ইতিকথা ০৩ # ইতিহাস দ্রষ্টব্য) ।
সেই দুই দিন ছোটম্মা তার সাথে ছিল বাবার ঘরে। বাবা অন্য ঘরে ছিল। তবে সব সময় তার প্রতি খেয়াল রেখেছে। শত ব্যস্ততার মধ্যেও ঘরে এসে তার শরিরের অবস্থা দেখে গিয়েছে। মাথার কাছে বসে তাকে সাহস দিয়েছে, মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেছে। দাদির মৃত্যুর ব্যপারটা নিয়ে মনে মনে একটা অপরাধবোধ কাজ করছিল তার মধ্যে। নিজেকে সে এর জন্য দায়ি মনে করছিল। কিন্তু বাবা তাকে বুঝিয়েছে এতে তার কোন দোষ নাই, তাকে আরো শক্ত হতে হবে।
র্মেদা বংশের রক্তে অপরাধবোধের কোন জায়গা নাই। কিন্তু অপরাধবোধ কাটিয়ে উঠতে পারছেনা রেবেকা। দুই দিন পরে একটু সুস্থ বোধ করাতে রাজিব আর ছোটম্মার কাধে ভর দিয়ে নিজের রুমে চলে আসে সে। দাদির কুলখানির অনুষ্টানের সময় তাকে দেখতে আসে নীলারেনু চৌধুরী। তখনও রেবেকা অসুস্থ, শরির দুর্বল। ঘরের বিছানায় শুয়ে ছিল। নীলারেনুকে দেখে তার ভাল লাগে। বয়সে তার মায়ের সমান হবে কিন্তু দেখে মনে হয়না এতটা বয়স্কা।
সেদিন নিলারেনু চৌধুরী রেবেকার মাথার পাশে বসে তার সাথে অনেক্ষন গল্প করেছে।
বানুর সাথে নিলারেনু চৌধুরীর সখ্যতা গড়ে উঠেছিল খুব অল্প সময়ের জন্য, বেচে থাকলে তাদের সম্পর্ক আরো দুর গড়াত- এসব কথা শুনতে শুনতে নিলারেনু চৌধুরীকে পছন্দ করে ফেলে রেবেকা। এত বছর পরে সে তার মা এর অভাব বোধ করে। মনে মনে নিলারেনু চৌধুরীকে তার মায়ের জায়গায় কল্পনা করা শুরু করে দেয়।
তারপর একদিন নিলারেনু চৌধুরীরে সাথে দেখা করার জন্য বাবার কাছ থেকে অনুমতি নেয়- চৌধুরী বাড়িতে যাবে!
খলিল মের্দাও বেশ কিছু দিন যাবত এই ধরনের একটা কাজ করার কথা ভাবছিল। তাই মেয়েকে চৌধুরী বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দিয়ে দেয় এক কথায়।
তারপর ঝড়ের মত হুট করে তিনটা বছর কিভাবে কেটে যায় টের পায়না রেবেকা। বিছানায় শুয়ে আলসেমি করতে করতে শুধু গত তিনটা বছরের কথা ভাবছিল সে।
মের্দা বংশের হয়ে প্রথম চৌধুরী বাড়িতে পা রাখা, নীলারেনুর আদর, সত্য নারায়ন চৌধুরীর বিরক্তি মাখা দৃষ্টি, রিচার্ডদার মুখে খৃষ্টান র্ধমের কথা, নৌকা ভ্রমন এবং গোটা একটা দিন হারিয়ে যাওয়া- সব কিছু নিয়ে চমৎকার ভাবে কেটে গেল তিনটা বছর। বলা যায় পুরাটা সময় চৌধুরী বাড়ি মাথায় তুলে রাখত রাজিব আর রেবেকা। এর মধ্যে সপ্তাহের বন্ধে দুই দিনের জন্য গ্রামে চলে আসত নীলারেনু। সাথে তার ছেলে মেয়ে আদি-রুদ্রাকেও নিয়ে আসত। তারপর কিভাবে দুইটা দিন পেরিয়ে যেত টেরই পেত না ওরা।
সময়টা আজকে খুব বেশি করে মনে পড়ছে রেবেকার।
দরজা খোলার শব্দে বর্তমানে ফিরে আসে।
– একি! এখনও বিছানায়!
– উম!
– কত কাজ বাকি তোমার। এত আলসেমি করলে চলবে।
তাড়া দেয় মর্জিনা। ভোর বেলা সে দুই ভাই-বোনকে বিছানায় রেখে উঠে পড়েছিল। সবার জন্য সকালের খাবার বানিয়ে বাড়ির আরো কিছু কাজ গুছিয়েছে এতক্ষন। এর মধ্যে রাজিবকে দেখেছে, ঘুম থেকে উঠে নিজের ঘরের দিকে যাচ্ছে। কিন্তু রেবেকার কোন সারা শব্দ নাই দেখে এক চাকরকে দিয়ে রাজিবের গোসল করার পানি পাঠিয়ে দেখতে এসেছে রেবেকার কি অবস্থা।
– ছোটম্মা, আরেকটু,,,
– একটুও না। এখনি উঠ। গোসল করে, খেয়ে তৈরি হয়ে নাও। অনেকটা ধমকের সুরে কথাগুলো বলল মর্জিনা। রাজিব আর রেবেকার সামনে সে ভুলে যায় যে সে এ বাড়ির চাকর।
– এহ! আমাদের বিদায় করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছ মনে হচ্ছে।
রেবেকার কন্ঠে মেকি তিরস্কারের সুর।
– হ্যা। লেগেছি। চল, উঠ এখন। আমি দেখি তোমার ভাইয়ের কদ্দুর কি হল।
ঘর থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছিল মর্জিনা। পেছন থেকে ডাক দিল রেবেকা-
– ছোটম্মা।
– কি!
– তোমাকে দাদির মত লাগছে।
হেসে উঠল মর্জিনা রেবেকার কথায়।
– এত বুড়া মনে হচ্ছে?
– আরে না। দাদি যেমন সব সময় সারা বাড়ি দৌড়ে বেড়াত আর সবাইকে ধমকের উপরে রাখত তুমিও তাই করছ । বিছানা ছেড়ে নামতে থাকল রেবেকা মর্জিনার দিকে তাকিয়ে। গায়ের চাদরটা বিছানায় রয়ে গেল। সম্পূর্ন নগ্ন অবস্থায় রেবেকাকে তার দিকে আসতে দেখে আতকে উঠল মর্জিনা। তাড়াতাড়ি দরজা বন্ধ করে দিল সে।
– হায় আল্লা! তোমার কোন কান্ড জ্ঞান নাই!
– না নাই। রেবেকা মর্জিনার সামনে এসে দুহাতে মর্জিনার মাথাটা ধরে টেনে নামিয়ে আনল তার মুখের উপরে। চেপে ধরে মর্জিনার ঠোটে ঠোট গুজে দিল।
– উমম! আহা, ছাড়! সুমিতাদিকে উঠানে দেখেছি একটু আগে। রেবেকার ঠোট থেকে ঠোট ছাড়িয়ে নিল মর্জিনা।
– থাকুক গা।
– দেখ, আমি চাইনা সুমিতাদি এসব জানুক।
– তুমি সুমিতা মাসিকে দেখতে পার না, আমি জানি।
– আমি উনাকে বিশ্বাস করি না।
– আমিও না। আবার মর্জিনার ঠোটে ঠোট ছোয়ানোর জন্য মাথা উচু করল রেবেকা। নিজের নগ্ন শরির দিয়ে দরজার সাথে চেপে ধরেছে মর্জিনাকে। শাড়ির উপর দিয়ে মর্জিনার ফুলে উঠা বুক দেখে হিংসা হচ্ছে তার। মর্জিনাও এবার মাথা নামিয়ে রেবেকার পাতলা ঠোট দুইটা তার ঠোটে টেনে নিল। কিছুক্ষন দুজনেই দুজনের স্বাদ নিল জিব দিয়ে। তারপর রেবেকার ঠোট ছেড়ে দিল মর্জিনা।
– হয়েছে। এবার তৈরি হয়ে নাও। গোসল, খাওয়া, কাপড়…
– কাপড়! আমার জামা কাপড় এনে দাও। রাতে তুমি আর রাজিব আমার কামিজ ছিড়েছ ইচ্ছা করে। এখন এভাবে আমি আমার ঘর পর্যন্ত যেতে পারব না।
– কাপড় আমি এনে রেখেছি ভোর বেলাতেই। ওই যে আলনায়।
রেবেকাকে আলনার দিকে ইশারা করে দরজা খুলে বের হয়ে গেল মর্জিনা। রাজিবের গোসল হল কি না খবর নিয়ে তাকে যেতে হবে ছাদে। আচারের বৈয়ম শুকাতে দিয়েছিল। নামাতে হবে।
সব সময় সব দিকে খেয়াল থাকে মর্জিনার।
আজকে যশোর যাচ্ছে রেবেকা আর রাজিব। ওখান থেকে কলকাতা। বড় একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ওদের ভর্তি করার ব্যবস্থা করেছে নিলাবৌদি। মন থেকে সায় না পেলেও রাজি হয়েছে খলিল মের্দা। উচ্চতর লেখাপড়া শেখা দরকার। সব বাড়ির ছেলে-মেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে। মের্দা বাড়ি পিছিয়ে থাকবে কেন? সুমিতারও এতে সায় আছে জেনে মনে সাহস পেয়েছে খলিল।।
সুমিতার ছেলে-মেয়েও যাচ্ছে রাজিব-রেবেকার সাথে। খলিল মের্দা ওদেরকে নিজের সন্তানের চেয়ে কম মনে করে না তাই এক সঙ্গে চার জনকেই পাঠাচ্ছে শহরে।
কিন্তু মনটা খারাপ হয়ে আছে সকাল থেকে। হুট করে এত বড় বাড়িটা খালি হয়ে যাবে ওরা চলে গেলে।
ইংরেজ সরকারের শাসন আমলে প্রত্যেকটা গ্রামেই ছোট-বড় অনেক চার্চ করা হয়েছিল। ফাদাররা খৃষ্টান ধর্ম প্রচারের নামে বৃটিশ সম্রাজ্য বিস্তারে সাহায্য করত সরকারকে। কিন্তু বেশ কিছু বড় বড় পরিবার তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য এসব চার্চ-টার্চ এড়িয়ে চলত। সামনা সামনি কিছু না বললেও অন্তর থেকে পছন্দ করত না বৃটিশদের।
এর মধ্যে বেশ কিছু অঞ্চলে বিদ্রহের শিখা জ্বলে উঠেছে। ধারনা করা হয় এসব বিদ্রহীদের আশ্রয় ও খাদ্য দিয়ে সাহায্য করছে সংখ্যালঘু কিছু পরিবার যারা উপরে উপরে বৃটিশদের গোলামি করলেও তলে তলে দেশের সাথে আছে।
সন্দেহের তালিকায় প্রথম নামটা চৌধুরী বাড়ির।
সত্য নারায়ন চৌধুরী। ষাটোর্ধ বিপত্নীক মানুষ। ছেলে মেয়ে সবগুলাকেই বাইরে লেখাপড়ার জন্য পাঠিয়ে দিয়েছে এবং তারা ওখানেই স্থায়ী হয়ে গিয়েছে। এখন এই বৃদ্ধ বয়সে সব স্বাদ আল্বাদের উর্ধে চলে এসেছেন সত্য নারায়ন। জীবনে প্রচুর পাপ করেছেন। তার প্রাশচিত্ত করার জন্য শেষ সময়টুকু পূজা আর্চনা করে কাটিয়ে দিচ্ছেন।
মাঝে মধ্যে বড় ছেলে বউ-বাচ্চা নিয়ে গ্রামে আসে। সেই সময়টাতে কোলাহলে ভরে উঠে সারা বাড়ি কয়েকদিনের জন্য। তারপর ওরা চলে গেলে আবার বাড়িটা মরে যায়।
বড় ছেলের বউ নীলারেনু বেশ ঘন ঘন গ্রামে আসছে কিছুদিন যাবত। ছেলে-মেয়ে দুটার স্কুলে ছুটি হলেই চলে আসে। কিন্তু চৌধুরী বাড়ির বড় ছেলে বিশ্বজিত চৌধুরী আসতে পারেনা সব সময়। ব্যবসার কাজে অনেক ব্যস্ত থাকে বিশ্বজিত।
কোলাহল পছন্দ না সত্য নারায়ন চৌধুরীর। সে আজকাল একা নিজের মত থাকতে চায়। পরিচিত মানুষের চোখের নজরে থাকতে বিরক্ত বোধ করে। রেবেকা আর রাজিব কে দেখলে অনেক পুরান কথা মনে পড়ে যায় তার। অস্থির হয়ে যায় এত কিছু মনে পড়লে। কিন্তু নিজেকে সামলে রাখে ভবিষ্যতের ভালোর জন্য (মের্দা বাড়ির ইতিকথা ০৯ # চৌধুরী বাড়ির ইতিকথা দ্রষ্টব্য)।
একই কারনে খলিল মের্দা কিংবা মের্দা বাড়ির কারো সামনেই যেতে পারেনা সে। মনে মনে একটা তিব্র রাগ দানা বেধে উঠে যখন মের্দা বাড়ির কাউকে দেখে। বাপ-দাদার কাছ থেকে পাওয়া এই রাগ এই তিব্র ঘৃনা এখন পর্যন্ত বুকে বয়ে বেরাচ্ছে সত্য নারায়ন চৌধুরী। অনীল মের্দা্ কিংবা রাজিয়া বেগম যেরকম করে চৌধুরী বাড়ির মানুষদের ঘৃনা করে তার চেয়েও ভয়ংকর ভাবে সত্য নারায়ন ঘৃরা করে ওদের।
এই দুই পরিবারের কোন্দলের সুত্রপাত অনেক বছর আগে হলেও এর কিছুটা দায় সত্য নারায়ন চৌধুরীর আর রাজিয়া বেগমের ঘাড়ে পড়ে। তখনও রাজিয়া বেগম মের্দা বাড়ির বউ হয়নি, বয়স অনেক কম। কিন্তু সব সময় নিজের ভালটা বুঝে নিত। এবং নিজের ভালোর জন্য অনেক দুর পর্যন্ত যেতেও পিছপা হত না (মের্দা বাড়ির ইতিকথা ০৯ # চৌধুরী বাড়ির ইতিকথা দ্রষ্টব্য)।
পুরনো দিনগুলো হুট করে মনে পড়তে একটা হতাশার দির্ঘশ্বাস বেড়িয়ে গেল সত্য নারায়নের বুক থেকে।
বৃটিশদের বিরুদ্ধে দাড়াতে হলে সবাইকে এক হতে হবে কথাটা আজকাল মন থেকে মানে সত্য নারায়ন। এই জন্য সে তার বড় পুত্রবধুর প্রতি কিছুটা কৃতঞ্জ। নীলারেনুর জন্য এখন এই দুই বাড়ির মধ্যকার সম্পর্ক কিছুটা ভাল অবস্থায় এসেছে। এইবার নীলারেনু তার সাথে করে মের্দা বাড়ি বড় ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে যাচ্ছে শহরে লেখাপড়ার জন্য। এতে নাকি খলিল মের্দারও সায় আছে।
কথাটা শুনে প্রথমে বিশ্বাস হয়নি সত্য নারায়নের। কিন্তু যখন ওরা সবাই একই বজরায় করে গ্রাম ছাড়ল তখন বিশ্বাস হল, মের্দা বাড়ি আর চৌধুরী বাড়ি এক হতে যাচ্ছে।